লেখক: মাসুদ আলম
টোকিও অলিম্পিকের রংবেরঙের খবরের ভিড়ে একটি খবর চোখ কেড়েছে আলাদাভাবে। মাত্র ৬৪ হাজার জনসংখ্যার দেশ বারমুডা সোনার পদক জিতেছে মেয়েদের ট্রায়াথলনে। গুগল করে দেখা গেল, বিশ্ব মানচিত্রে ৫৩ বর্গকিলোমিটারের ক্ষুদ্র বিন্দু বারমুডা ঢাকার বৃহত্তর মিরপুর অঞ্চলের (সাড়ে ৫৮ বর্গকিলোমিটার) চেয়ে ছোট। অথচ দেশটি ৮৫ বছর অপেক্ষার পর বাজিমাত করেছে অলিম্পিকের মঞ্চে।
ক্ষুদ্র দেশ সান মারিনো দিয়েছে আরও বড় চমক। জনসংখ্যার ভিত্তিতে টোকিও অলিম্পিকে সোনা জেতা সবচেয়ে ছোট দেশ এটি। সান মারিনোর মেয়েরা ট্র্যাপ শুটিংয়ে জিতেছেন ব্রোঞ্জ। ৬১ বর্গকিলোমিটারের এই দেশের জনসংখ্যা মাত্র ৩৪ হাজার। এভাবে লাখের নিচে জনসংখ্যার দেশও বিশ্বের সর্ববৃহৎ ক্রীড়ানুষ্ঠানে নিজেদের জাতিসত্তার পরিচয় তুলে ধরছে পদক জয়ের মাধ্যমে। পরিচিত গণ্ডির মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার ছোট দেশ শ্রীলঙ্কাও অলিম্পিকে পদক জিতেছে। ১৯৪৮ লন্ডন অলিম্পিকে পুরুষ ৪০০ মিটার হার্ডলসে একটি রুপা জয়ের পর তারা দ্বিতীয়টি ঘরে তুলেছে ২০০০ সালের সিডনি অলিম্পিকে। ২০০ মিটার স্প্রিন্টে সেবার সুশান্তিকা জয়াসিংহে রুপা জেতেন।
কিন্তু বাংলাদেশসহ ৫০টির বেশি দেশ আজও পারেনি অলিম্পিকে পদক জিততে। অলিম্পিকে পদক না জেতা সবচেয়ে জনবহুল দেশটির নাম কী? অনেক সময় কুইজের প্রশ্ন। উত্তর—বাংলাদেশ। জনসংখ্যা বা আয়তনের ভিত্তিতে আসলে পদক আসে না অলিম্পিকে। সেটাই যদি হতো, তাহলে প্রায় ১৪০ কোটি মানুষের দেশ ভারত ধুঁকত না টোকিও অলিম্পিকে। গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত বিপুল প্রত্যাশার বিপরীতে টোকিওতে ভারত মাত্র দুটি পদক জিতেছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে অলিম্পিকে ভারতের মোট পদক এখন ৩০, পাকিস্তানের ১০। বাংলাদেশ কবে একটি অলিম্পিক পদক জিতবে? বারমুডা-সান মারিনো পারলে আমরা পারি না কেন?
টিভির পর্দায় টোকিও অলিম্পিকের কোনো ইভেন্ট দেখতে দেখতে প্রশ্নগুলো এখন ছুড়ে দিচ্ছেন অনেকেই। যদিও আর্চার রোমান সানা টোকিও অলিম্পিকে ভালো খেলার আত্মবিশ্বাসে বিশ্ব আর্চারির ওয়েবসাইটে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ২০২৮ অলিম্পিকে তিনি সোনা জিততে চান। তাঁর আশা আর বাস্তবতার মধ্যে দুর্লঙ্ঘ কোনো প্রাচীর রয়েছে, এমন নয়। এই প্রাচীর নিশ্চয়ই ভাঙা সম্ভব। হয়তো ২০২৮ নয়, আরও সময় লাগতে পারে। দরকার শুধু একটা ‘মহা পদক প্রকল্প’ হাতে নেওয়া। যেমনটা ২০১০ সালে দীর্ঘ মেয়াদে অনুশীলনের ব্যবস্থা করায় দক্ষিণ এশিয়ান গেমসে ৩ থেকে এক লাফে ১৮টি সোনা জেতে বাংলাদেশ। অলিম্পিকে পদক জয়ের এমন একটা উদ্যোগ নিলে একসময় ফল আসতে বাধ্য।
ক্রীড়া প্রশাসনকে বুঝতে হবে, অলিম্পিকে একটি পদক জেতা অনেকটা খাড়া পাহাড়ে ওঠার মতো। তাই অনেক বেশি চেষ্টা দরকার। শুধু ‘গেলাম আর ফিরে এলাম’, এমনটা চলতে পারে না অনির্দিষ্টকাল। অবশ্য ১৮৯৬ সালে শুরু হওয়া অলিম্পিকের জনক ব্যারন দা কুবার্তের মূলমন্ত্র ‘জয়লাভ নয়, অংশগ্রহণই বড় কথা’ বাণীকে আঁকড়ে থাকলে ভিন্ন কথা। তবে বাংলাদেশের খেলোয়াড়েরা ‘অংশগ্রহণই বড় কথার’ ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছেন। অ্যাথলেট জহির রায়হান ও শুটার আবদুল্লাহ হেল বাকি ছাড়া এবার টোকিও অলিম্পিকে বাংলাদেশের অন্য চার খেলোয়াড়ই নিজের সেরাটা তুলে ধরেছেন। দুই সাঁতারু আরিফুল ইসলাম ও জুনায়না আহমেদ নিজের রেকর্ড টাইমিং করেছেন। আর্চার রোমান সানা ও দিয়া সিদ্দিকী মিশ্র ইভেন্টে বাছাই পর্ব পেরিয়ে নকআউটে খেলেন। যদিও নকআউটের প্রথম ধাপেই বিদায়। এককে রোমান সেরা ১৬-তে ওঠার লড়াইয়ে ১ পয়েন্টের জন্য হেরেছেন। দিয়া সেরা ৩২-এ আসতে পারেননি টাইব্রেকে হেরে।
মন্দের মধ্যেও আর্চারি ভালো করেছে ‘তির গো ফর গোল্ড’ কর্মসূচির আওতায় সিটি গ্রুপের মতো প্রতিষ্ঠান পাশে ছিল এবং আছে বলে। সঙ্গে দু-একজন উদ্যমী মানুষের কর্মপ্রচেষ্টা। কিন্তু বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে নিবেদিতপ্রাণ সংগঠক ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছেন। ক্রীড়াঙ্গনে চলছে রাজনৈতিক শক্তির দৌরাত্ম্য। অনেক অযোগ্য ব্যক্তি ফেডারেশনের চেয়ার দখলে রেখেছেন। ফলে দু-একটি বাদে বাকি খেলাগুলোয় উন্নতি নেই। দক্ষিণ এশিয়ান গেমসেই বাংলাদেশ এখনো পেছনের বেঞ্চের ছাত্র। অলিম্পিক তো অনেক দূরের পথ।
১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ থেকে লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিকে যাওয়া প্রথম ক্রীড়াবিদ তৎকালীন দ্রুততম মানব সাইদুর রহমান (ডন) সে সময় গেমস শেষে দেশে ফিরে বলেছিলেন, ‘আমরা অলিম্পিক থেকে ৫০ বছর পিছিয়ে।’ যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী সাইদুর কদিন আগে প্রথম আলোকে দেওয়া এক টেলিফোন সাক্ষাৎকারে আক্ষেপ নিয়ে বলেন, ‘১৮ কোটি মানুষের দেশ একজন ভালো অ্যাথলেট তৈরি করতে পারে না, এটা হতাশার। আমরা আসলে অলিম্পিক থেকে আরও পিছিয়েছি।’
তবে টোকিও অলিম্পিকে বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের সামগ্রিক পারফরম্যান্স সেটা বলে না। এমনিতে বরাবর হিটেই বাদ পড়েন বাংলাদেশের অ্যাথলেটরা, এবার আর্চারি লড়াই করেছে। তির-ধনুকের এই খেলাই এখন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশকে চেনাচ্ছে। আর্চারিই কি তবে অদূর ভবিষ্যতে অলিম্পিকে বাংলাদেশকে প্রথম পদক এনে দেবে?
দরকার কার্যকর দীর্ঘ মেয়াদে পরিকল্পনা আর অর্থ। টোকিও অলিম্পিকের জন্য ভারত সরকার এক হাজার কোটি টাকা ঢেলেছে তাদের ক্রীড়াবিদদের পেছনে। বাংলাদেশের আলাদাভাবে এই খাতে কোনো বাজেটই নেই। এ–ই যখন অবস্থা, বাংলাদেশের মতো দলগুলোর পক্ষে অলিম্পিকে গিয়ে মাথা তুলে দাঁড়ানো ভীষণ কঠিনই।
বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে অন্যতম বড় সমস্যা, প্রতিভাবানদের অনেকের হতাশার চোরাবালিতে হারিয়ে যাওয়া। ২০০২ সালে ম্যানচেস্টার কমনওয়েলথ গেমসে সোনা জেতা বাংলাদেশের তৎকালীন তরুণ আসিফ হোসেন খান যার বড় উদাহরণ। এই আসিফই ম্যানচেস্টারে ভারতের অভিনব বিন্দ্রাকে হারিয়ে সোনা জেতেন ১০ মিটার এয়ার রাইফেলে। বিন্দ্রা ২০০৮ বেইজিং অলিম্পিকে একই ইভেন্টে সোনা জিতে গর্বিত করেন ভারতকে। অলিম্পিকে এটিই ভারতের একমাত্র ব্যক্তিগত সোনা। বিন্দ্রা পেরেছেন, আসিফ হতাশার গহ্বরে তলিয়ে গেছেন।
সম্ভাবনাময় ক্রীড়াবিদদের ধরে রাখতে হবে। তাঁদের দিতে হবে জীবন-জীবিকার নিশ্চয়তা। সেটিই নেই বাংলাদেশে। তা ছাড়া দেশে খেলাধুলার সংস্কৃতিও হারিয়ে গেছে। ক্রীড়াপ্রেমীদের অনেকেই ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা নিয়ে মারামারিতে লিপ্ত হন। কিন্তু ক্রিকেট বাদে নিজ দেশের অন্য খেলাধুলা নিয়ে অনাগ্রহ বাড়ছে। কর্তাব্যক্তিরা গেমসের সৌন্দর্য দর্শন শেষে দেশে ফেরেন। তারপর গেমসের নানা স্মৃতি জোড়া লাগিয়ে বক্তৃতা দেন। কিন্তু তাঁদের বক্তব্যে অলিম্পিকে পদক জয়ের কার্যকর আর দীর্ঘ মেয়াদে পরিকল্পনার কথাই শুধু থাকে না। থাকলে হয়তো আরেকটু এগোনো যেত।
লেখক: মাসুদ আলম প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি
সূত্র: প্রথম আলো
তারিখ: আগষ্ট ০৪, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,