কয়েক বছর ধরেই অর্থনৈতিক সংকট চলছে দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপদেশ শ্রীলঙ্কায়। তবে এ বছরের শুরু থেকেই এই সংকট তীব্র আকার ধারণ করে। নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দাম আকাশছোঁয়া। জ্বালানির অভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হয়। এই পরিস্থিতিতে দেশটি বাঁচবে কীভাবে, তা নিয়েই এখন জল্পনা–কল্পনা। তবে জাতিসংঘ দেশটিকে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে মুদ্রা বিনিময় করে ডলার গ্রহণ ও নাগরিকদের জন্য সাময়িক মৌলিক উপার্জন নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়েছে।
বিভিন্ন দেশের কাছে ঋণে জর্জরিত শ্রীলঙ্কা শেষমেশ নিজেকে ‘অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া’ ঘোষণা করে। তার পর থেকেই প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে ও প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষের পদত্যাগের দাবি জোরালো হয় এই দ্বীপরাষ্ট্রে। শেষমেশ মাহিন্দা রাজাপক্ষে পদত্যাগ করে জনরোষ থেকে বাঁচতে এক নৌঘাঁটিতে আশ্রয় নিয়েছেন বলে সর্বশেষ খবরে জানা গেছে।
২০১৯ সালে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) একটি ওয়ার্কিং পেপারে বলা হয়, ‘শ্রীলঙ্কা ইজ এ ক্ল্যাসিক টুইন ডেফিসিট ইকোনমি’। টুইন ডেফিসিটের অর্থ হলো, একটি দেশের জাতীয় ব্যয় তার জাতীয় আয়ের চেয়ে বেশি এবং দেশটির বাণিজ্যিক পণ্য ও পরিষেবার উৎপাদন অপর্যাপ্ত।
বিশ্লেষকেরা বলেন, ঋণখেলাপি শ্রীলঙ্কার সর্বনাশের মূল কারণ হলো, বাণিজ্যিক ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় বন্ড বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে নির্বিচার বিক্রি করা। অর্থাৎ শ্রীলঙ্কা সরকার আগপিছ বিবেচনা না করে ডলারে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করেছে।
এই ডলারভিত্তিক সঞ্চয়পত্র দেশটির সর্বমোট বৈদেশিক ঋণের প্রায় অর্ধেক। রাষ্ট্রীয় রিজার্ভে ডলারের পরিমাণ তলানিতে ঠেকার কারণে এই সঞ্চয়পত্রের কিস্তিভিত্তিক মুনাফার অর্থ দিতে শ্রীলঙ্কা সরকার ব্যর্থ হয়েছে।
জরুরি আমদানি ব্যয় মেটাতে ডলারের জন্য এখন তাই শ্রীলঙ্কার সরকার আইএমএফের কাছে হাত পাতছে। পরিস্থিতির উন্নতি হলে সঞ্চয়পত্রের সুদের অর্থ বিদেশি বিনিয়োগকারীদের পরবর্তীকালে শোধ করবে। অর্থাৎ শ্রীলঙ্কা প্রাথমিকভাবে বৈদেশিক মুদ্রায় বিক্রি করা সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে নেওয়া ঋণের পুনঃতফসিলিকরণ করছে। এটা শ্রীলঙ্কার মোট বৈদেশিক ঋণের প্রায় ৫০ শতাংশ।
শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি মূলত তিনটি খাত ঘিরে ঘুরপাক খায়—তৈরি পোশাক, পর্যটন ও চা। অর্থনীতির বহুমুখীকরণ করতে পারেনি তারা। আর কোভিডের সময় দেখা গেল, যেসব দেশ পর্যটনের ওপর বেশি নির্ভরশীল, তারাই বেশি মার খেয়েছে। শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রেও তা ঘটেছে। গত দুই বছরে পর্যটন খাত থেকে তারা তেমন একটা রাজস্ব আয় করতে পারেনি। অথচ পর্যটন থেকে তারা বছরে ৫০০ থেকে ৬০০ কোটি ডলার উপার্জন করে।
কোভিডের আগে ২০১৯ সালে কলম্বো শহরে ইস্টার সানডে চলার সময় কয়েক দফা বোমা হামলায় দুই শতাধিক মানুষ নিহত হওয়ার পর থেকেই পর্যটক কমতে শুরু করে শ্রীলঙ্কায়। তবে গত বছর কোভিডের প্রভাব কাটিয়ে শ্রীলঙ্কায় পর্যটক আসা শুরু হলেও ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা শুরু হওয়ার পর আরেক দফা ধাক্কা খায় শ্রীলঙ্কা। কারণ, তাদের পর্যটকদের বড় একটি অংশ রুশ নাগরিক। এখানেই শেষ নয়, শ্রীলঙ্কার চায়ের বড় বাজার হচ্ছে রাশিয়া। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর রাশিয়ার সঙ্গে লেনদেন করা সম্ভব হচ্ছে না তাদের পক্ষে।
কৃষি উৎপাদন কমেছে শ্রীলঙ্কার। ২ কোটি ২০ লাখ মানুষের দেশ শ্রীলঙ্কায় সার ব্যবহার নিষিদ্ধ হওয়ায় ধান ও চায়ের উৎপাদন কমে যায়। এ ছাড়া দেশটির মানুষের মাথাপিছু আয় সাড়ে তিন হাজারের বেশি। ফলে সেখানে শ্রমিকের মজুরি বেশি। এত মজুরিতে শ্রমিক নিয়োগ দিয়ে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করা বড় চ্যালেঞ্জ। কৃষির যন্ত্রীকরণ শুরু করেছিল তারা, কিন্তু উৎপাদন শেষমেশ বৃদ্ধি করতে পারেনি।
শ্রীলঙ্কার বর্তমান সংকটের অন্যতম কারণ হলো, ২০১৯ সালের নির্বাচনী প্রচারণার সময় রাজাপক্ষের কর হ্রাসের প্রতিশ্রুতি। করোনা মহামারি শুরুর কয়েক মাস আগে শ্রীলঙ্কা সরকার কর হ্রাসের সিদ্ধান্ত কার্যকর করে। বলা যায়, এই সিদ্ধান্ত ছিল মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো।
মুদ্রা বিনিময়
এই বাস্তবতায় শ্রীলঙ্কা এখন আইএমএফসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার দ্বারস্থ হয়েছে। আইএমএফের শর্ত, আলোচনায় ভারতকে থাকতে হবে। জাতিসংঘের পরামর্শ হলো, শ্রীলঙ্কা এখন ভারত, চীনসহ অন্যান্য প্রতিবেশীর সঙ্গে মুদ্রা বিনিময় করে ডলার নিতে পারে। ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস সূত্রে এই খবর পাওয়া গেছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের কাছ থেকে মুদ্রা বিনিময়ের আওতায় ২০ কোটি ডলার ঋণ নিয়েছে শ্রীলঙ্কা। এর বিপরীতে তারা সমপরিমাণ শ্রীলঙ্কার রুপি জমা রাখছে।
সূত্র: প্রথম আলো।
তারিখ: মে ১১, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,