জিডিপি কার কথা বলে?
স্বার্থপর পৃথিবীতে আমরা ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত সাফল্যের মাপকাঠি বানাই স্বার্থপরতার একচ্ছত্রবাদকে উঁচিয়ে ধরার জন্য। যেমন যে যত বেশি ধনী, সে তত বেশি সফল ব্যক্তি। যে ব্যবসায় যত বেশি লাভ করে, সে তত বেশি সফল। যে দেশের মাথাপিছু জিডিপি যত বেশি, সে দেশ তত বেশি উন্নত। জিডিপি দিয়ে আমরা কী জানলাম? আমাদের মাথাপিছু দেশজ উৎপাদন কত হয়েছে তা জানলাম। কিন্তু তাতে দেশের ও মানুষের পরিস্থিতির কতটুকু জানা হলো? এর মাধ্যমে কি আমরা জানতে পারলাম দেশের দারিদ্র্যের পরিস্থিতি কী? হয়তো দেশে বাঘা কিছু ধনী লোক আছেন, যঁারা জিডিপির ৯৯ শতাংশের মালিক। তাতে সাধারণ মানুষের তো ভয় পাওয়ার কথা। আনন্দিত হওয়ার তো কোনো কারণই নেই। মানুষের প্রকৃত পরিস্থিতি জানতে হলে এমন একটা পরিমাপ বের করতে হবে, যেটা আসবে জিডিপির সঙ্গে দেশের দারিদ্র্য, বেকারত্ব, স্বার্থহীনতা, আয়বৈষম্য, পরিবেশদূষণ, সবার কাছে শিক্ষা ও প্রযুক্তির প্রাপ্যতা, নারীর ক্ষমতায়ন, মানবিক অধিকার, সুশাসন ইত্যাদির পরিমাপ যুক্ত করে।
স্বার্থপর পৃথিবীতে বিশ্বায়নের যে চমৎকার সুযোগটা এসেছে, সেটাও চলছে উল্টা দিকে। পরস্পরের প্রতি বন্ধুত্ব সৃষ্টির সুযোগ না হয়ে এটা হয়ে পড়ছে বাজার দখলের লড়াই। এক রাষ্ট্রের শোষণযন্ত্র থাবা বিস্তার করার সুযোগ পাচ্ছে আরেক রাষ্ট্রের মানুষের ওপর। বিশ্বপরিবার গড়ার জায়গায় বিশ্ব পরিণত হতে যাচ্ছে অর্থনৈতিক রণক্ষেত্রে।
প্রযুক্তি
যে মন-ভোলানো, চোখ-ধাঁধানো প্রযুক্তি একটার পর একটা আমাদের জীবনের সর্বক্ষেত্রে দ্রুত বিস্তার লাভ করছে এবং তার চেয়ে দ্রুততর গতিতে আমাদের জীবনকে সার্বিকভাবে প্রভাবিত করছে, তার ফল আমাদের ওপর কেমন হবে? প্রতিদিন মনে হচ্ছে, দৈনন্দিন জীবনের অতিপরিচিত পথে একটা অজানা চমক আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। সেই চমক আমাদের জীবনকে আরও উপভোগ্য করবে, সহজ করবে; নাকি কারও জন্য সহজ, কারও জন্য কঠিন করবে।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, এটা ভালো হচ্ছে। কিন্তু যদি অর্থনীতির মূল যন্ত্রটিকে ঘিরে প্রযুক্তি এগোতে থাকে, তাহলে এই নতুন প্রযুক্তি স্বার্থপরতার শক্তিকে আরও জোরদার করবে। যেহেতু স্বার্থপর পৃথিবীতে আর কিছু করণীয় দেখা যাবে না। অনেকে এ নিয়ে আপত্তি তুলবে। সমাধান হিসেবে এদিকে-ওদিকে কিছু স্বার্থহীনতার প্রলেপ লাগানোর চেষ্টা হবে। নিয়মনীতি ভেঙে কেউ কেউ প্রযুক্তির শক্তি দিয়ে চাপা দেওয়া স্বার্থহীনতার শক্তিকে প্রকাশ করার উদ্যোগ নেবে। কিন্তু মূল যন্ত্র তার কাজ নির্দিষ্ট নিয়মে করে যাবে।
প্রযুক্তি আমাদের জীবনকে পাল্টে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। কিন্তু এ পরিবর্তন আসছে বিচ্ছিন্নভাবে, মূলত খণ্ড খণ্ড স্বার্থপর লক্ষ্য সামনে রেখে। এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়, কোনো বৈশ্বিক স্বপ্ন সামনে রেখে এই পরিবর্তন আসছে না। নতুন একটা প্রযুক্তি এলে আমরা উচ্ছ্বসিত হই—ইশ্ এটাকে যদি সব মানুষের স্বাস্থ্যসেবায় পরিবর্তন আনার কাজে লাগানো যেত, যদি দারিদ্র্যমোচনের কাজে লাগানো যেত, যদি পরিবেশ রক্ষার কাজে লাগানো যেত। কিছু চেষ্টাও হয় এ লক্ষ্য সামনে রেখে। কিন্তু বেশি দূর এগোনো যায় না। সবার চোখে স্বার্থপরতার চশমা লাগানো। এই চশমা ভেদ করে স্বার্থহীন উদ্দেশ্য সাধনে বেশি দূর যাওয়া যায় না। কারণ, এই চশমা দিয়ে স্বার্থহীনতার রাস্তায় বেশি দূর দেখা যায় না। নব-আবিষ্কৃত প্রযুক্তির বাণিজ্যিক ব্যবহার নিয়ে সবাই এত ব্যস্ত থাকে যে অন্য ব্যবহারের কথা মনেই আসে না। স্বার্থহীন লক্ষ্য সামনে রেখে তার জন্য আনকোরা নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করার জন্য কাউকে পাওয়া যায় না। সৃজনশীলতা আর্থিক সাফল্যের রাজপথ ধরে চলতে থাকে। এ পথে এমন কোনো পথনির্দেশ দেওয়া থাকে না, যার থেকে জানা যাবে প্রযুক্তিকে কোন পথে নিয়ে গেলে সব সমস্যামুক্ত নতুন এক পৃথিবী গড়া যাবে। তার চেয়ে বড় কথা, পথনির্দেশ স্থাপন করবে কে? কারা ঠিক করছে আমাদের গন্তব্য কোথায়?
মানুষ হিসেবে আমাদের সম্মিলিত গন্তব্য কোথায়, এটা কি আমরা স্থির করে রেখেছি? যদি সেটা স্থির করা না থাকে, তবে আমরা আমাদের ব্যক্তিগত স্বার্থে যার যার পথে এগোব, এটাই তো স্বাভাবিক এবং তা-ই হচ্ছে। তাই বিপদ আমাদের পিছু ছাড়ছে না। জাতিসংঘ প্রণীত শতাব্দীর উন্নয়ন লক্ষ্য ছিল একটা সুনির্দিষ্ট গন্তব্য। তাই এটা সবার মনে আশার সঞ্চার করেছে। ২০০০ সাল থেকে পরবর্তী ১৫ বছরের মধ্যে মানবসমাজ হিসেবে আমরা কোথায় পৌঁছাতে চাই, এটা ছিল তার একটা চমৎকার দিকনির্দেশনা। এ কারণে আমরা অনেক সাফল্য অর্জনও করেছি। কিন্তু প্রযুক্তি এর পেছনে এসে দাঁড়ায়নি। জানা প্রযুক্তিকে আমরা এর জন্য মাঝেমধ্যে ব্যবহার করেছি, কিন্তু এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য আমরা সুনির্দিষ্ট প্রযুক্তি সৃষ্টি করার কথা ভাবতে পারিনি। কারণ, প্রযুক্তির জগৎ চলছে স্বার্থপর অর্থনীতির কড়া শাসনে।
শিক্ষাব্যবস্থা
শিক্ষাব্যবস্থাকে মূল অর্থনৈতিক কাঠামোর সঙ্গে সংগতিপূর্ণভাবে গড়ে তোলা হয়েছে বিশ্বজুড়ে। শিক্ষার মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে অর্থনীতির যন্ত্রটাকে সচল রাখার জন্য প্রশিক্ষিত কর্মচারী-গোষ্ঠী তৈরি করা। শিক্ষা সমাপ্তির পর প্রত্যেকে একটি চাকরি পেয়ে গেলে শিক্ষার মূল লক্ষ্য অর্জন হয়েছে বলে গণ্য করা হয়। শিক্ষা সমাপ্তির পর একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে চাকরি না পেলে নেমে আসে বেকারত্বের দুর্ভোগ।
এ রকম একটা অনুচ্চারিত অথচ শক্তিশালী লক্ষ্যকে ভিত্তি করে যে শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, তা যুগে যুগে সৃজনশীল তরুণসমাজকে স্বার্থপর ও ক্ষুদ্র চিন্তার গণ্ডিতে আবদ্ধ করে রেখেছে। তার মধ্যে প্রচলিত পৃথিবীকে গ্রহণ করার মানসিকতা দৃঢ়ভাবে পুঁতে দেওয়া হয়েছে। তাকে অন্যের হুকুম মানার জন্য তৈরি করা হয়েছে। কর্মস্থলের পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে চলার মানসিকতায় তাকে দীক্ষা দেওয়া হয়েছে।
শিক্ষাব্যবস্থার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত একজন তরুণের মনে বিশ্বাস জাগিয়ে দেওয়া যে মানুষের মধ্যে সীমাহীন শক্তি আছে। তার মধ্যেও সেই শক্তি সুপ্ত আছে। সেই সুপ্ত শক্তির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়াই হলো শিক্ষার সবচেয়ে বড় কাজ। তার সব শিক্ষা, ইতিহাস, ভূগোল, অঙ্ক, পদার্থবিদ্যা, সাহিত্য—সবকিছুর পেছনে থাকবে তার নিজেকে জানা। অতীতে যা কিছু ভালো কাজ হয়েছে, তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাকে প্রস্তুত করা। ‘ভালো পাস করলে, ভালো চাকরি পাবে’—এ ধারণার বদলে শিক্ষার্থীর মনে গেঁথে দেওয়া যে সে জীবনে যা কিছু অর্জন করতে চায়, তার একটা সূত্রপাত সে শিক্ষাজীবনেই করতে পারে।
শিক্ষা হলো তার প্রস্তুতি। এটা তার জন্য বোঝা নয়, এটা তার সম্পদ। তাকে বুঝিয়ে দেওয়া যে তার সামনে একটি নয়, দুটি পথ খোলা। সে যেন বিশ্বাস করে যে আমি চাকরিপ্রার্থী নই, আমি চাকরিদাতা। চাকরিদাতা হিসেবে সে যেন প্রস্তুতি নিতে থাকে। তার বিদ্যায়তনের প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীরা যারা চাকরিদাতা হয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তাদের সঙ্গে তার যোগাযোগ স্থাপনের ব্যবস্থা করে দেওয়া। তাকে বুঝতে দেওয়া যে সব মানুষই উদ্যোক্তা। এটা তার সহজাত ক্ষমতা। সাময়িকভাবে সে চাকরি করতে পারে, কিন্তু এটা তার কপালের লিখন মনে করার কোনো কারণ নেই। একবার কর্মচারী হলে, একবার শ্রমিক হলে তাকে সারা জীবন কর্মচারী বা শ্রমিক হিসেবে কাটাতে হবে, এমন কোনো ধারণা যেন তাকে দেওয়া না হয়। তাকে নিজের শক্তির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করতে হবে।
শিক্ষাব্যবস্থার আরেকটা কাজ হলো প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে পৃথিবী গড়ার কাজে উদ্বুদ্ধ করা। তাকে বুঝিয়ে দেওয়া যে বর্তমান পৃথিবীটা হচ্ছে অতীতে যারা ছিল এবং বর্তমানে যারা আছে, তাদের হাতে গড়া একটা বাস্তবতা। এই বাস্তবতায় যা যা দোষ-ত্রুটি আছে, সেগুলো উঠতি প্রজন্মকে সংশোধন করতে হবে এবং তা সংশোধনের জন্য তাদের প্রস্তুতি নেওয়ার সময়টাই হলো শিক্ষাকালীন সময়। এই সময়ের মধ্যে তাদেরকে নতুনভাবে আরেকটা পৃথিবী গড়ার জন্য প্রস্তুত হতে হবে। নতুন গড়ার ক্ষমতা তাদেরই হাতে। কিন্তু তাদেরকে প্রস্তুত হতে হবে কোন ধরনের পৃথিবী তারা গড়তে চায়, তার রূপরেখা তৈরি করার জন্য। প্রতিবছর প্রতি শ্রেণিতে তারা এককভাবে এবং সম্মিলিতভাবে নতুন পৃথিবীর রূপরেখা তৈরি করবে। পরের বছর সেটা পরিবর্তন-পরিবর্ধন করবে। শিক্ষা সমাপনের আগেই আগামী পৃথিবীর একটা ছবি তার মাথার মধ্যে যেন স্থান করে নিতে পারে। একবার এই ধারণাটা মাথায় স্থান করে নিলে ভবিষ্যৎ জীবনে তার কাজের মধ্যেও এটা প্রতিফলিত হতে আরম্ভ করবে। মানুষ হিসেবে আমাদের গন্তব্য সম্বন্ধেও তার একটা ধারণা সৃষ্টি হয়ে যাবে।
বেকারত্ব
বেকারত্ব মানে কী? পরিপূর্ণভাবে সক্ষম, কর্মের প্রতি আগ্রহশীল একজন মানুষ কোনো কাজ না করে দিনের পর দিন সময় কাটিয়ে যাওয়া—এটাই হলো বেকারত্ব। মানুষ কাজ করতে চায়, তার কাজ করার ক্ষমতা আছে, তবু সে কাজ করতে পারে না কেন? আমাদের অর্থনৈতিক যন্ত্রটা এমনভাবে বানানো যে এতে অনেকের জায়গা হয় না; তাই তাদের বসে বসে সময় কাটাতে হয়। তাহলে এটা কি মানুষের দোষ, না যন্ত্রের? অবশ্যই যন্ত্রের দোষ। আমরা কি কোনো দিন জিজ্ঞেস করেছি যন্ত্রের দোষে মানুষ কেন শাস্তি পাবে? কেন একজন কর্মক্ষম সৃজনশীল মানুষ এক অদৃশ্য শৃঙ্খলে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় জীবন কাটাতে বাধ্য হবে? এটা যদি যন্ত্রের দোষ হয়, তাহলে এ যন্ত্র যারা বানিয়েছে, তাদেরকে আমরা শাস্তি দিচ্ছি না কেন? আমরাই বা নতুন যন্ত্র বানাচ্ছি না কেন? যে মানুষ মঙ্গল গ্রহে বাসস্থান নির্মাণের চিন্তায় মশগুল হতে পারে, সেই মানুষ একটা উদ্ভট যন্ত্রকে বাতিল করে নতুন একটা যন্ত্র বানাতে পারছে না কেন?
পুরো জিনিসটার পেছনে আছে বর্তমান যন্ত্রের কারণে সৃষ্ট মানুষের প্রতি মানুষের বাধ্যতামূলক ঔদাসীন্য। পৃথিবীতে দু-চারজন লোক নয়, কোটি কোটি লোক বছরের পর বছর বেকার। আমরা শুধু ব্যাখ্যার জাল বুনে দায়িত্ব সমাপন করে যাচ্ছি। যে অমূল্য সম্পদের আমরা অপচয় করছি, মানুষের জন্য যে সীমাহীন যন্ত্রণার সৃষ্টি করছি, তা নিয়ে কারও কোনো দুশ্চিন্তা আছে বলে মনে হয় না।
এ ক্ষেত্রে আমরা দুটি পন্থায় সমাধান খোঁজার চেষ্টা করেছি। চেষ্টা করলে এর চেয়ে আরও ভালো সমাধান অন্যদের কাছ থেকে আসবে, এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত। একটা হলো, এখন বহুল পরিচিত ক্ষুদ্রঋণের ব্যবস্থা। গ্রামীণ ব্যাংক এটার জন্মদাতা। সারা পৃথিবীতে এখন এ বিষয়ে একটা সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে। এর মাধ্যমে প্রথম স্তরে স্বকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়। নারীদের মধ্যে এটা বিরাট পরিবর্তন সৃষ্টি করেছে। স্বকর্ম সৃষ্টি বেকারত্ব অবসানের প্রথম ধাপ। কারও কাছে চাকরিপ্রার্থী হওয়ার দরকার কী, আমি নিজেই নিজের কর্মসংস্থান করব। এর জন্য শুধু পুঁজি দরকার। ব্যাংকঋণ দিয়ে ব্যবসা শুরু করব।
দ্বিতীয় পদ্ধতি হলো, সামাজিক ব্যবসা তহবিল গঠন। এটাও অর্থায়নের একটা পদ্ধতি। গ্রামীণ ব্যাংক ঋণ দেয়, সামাজিক ব্যবসা তহবিল বিনিয়োগে অংশীদার হয়, ঋণ দেয়, অন্যান্য পন্থায় অর্থায়নের ব্যবস্থা করে। একবার ব্যক্তিগত মুনাফা অর্জনের অবস্থান থেকে সরে এলে কাজটা খুব সহজ হয়ে যায়। সামাজিক ব্যবসা তহবিলের পক্ষ থেকে একজন বেকারকে বলা হচ্ছে, ‘তুমি ব্যবসায় নামো, ব্যবসার বুদ্ধি নিয়ে আমাদের কাছে আসো। আমরা তোমার ব্যবসায় পুঁজি দেব। যত টাকা লাগে আমরা বিনিয়োগ করব, তুমি ব্যবসা চালাবে। ব্যবসার মুনাফা থেকে আমাদের পুঁজি আমাদের ফেরত দিয়ে তুমি পুরো মালিকানাটা নিয়ে নেবে।’ যেহেতু এটা সামাজিক ব্যবসা তহবিলের টাকা, সেহেতু এখানে কারও ব্যক্তিগত মুনাফার কোনো লোভ নেই। শুধু তহবিলের টাকাটা তহবিলকে ফেরত দিলেই হবে।
বেকারত্ব সৃষ্টির মূল কারণ দুটি: শিক্ষাব্যবস্থা; যেখানে চাকরিই একমাত্র ভবিষ্যৎ, এ রকম একটা ধারণার সৃষ্টি করা হচ্ছে। আরেকটি হলো ব্যাংকিং বা অর্থায়নের ব্যবস্থা। ব্যবসা করতে গেলে পুঁজি লাগে। বেকারকে বা গরিবকে পুঁজি দেওয়ার জন্য কেউ অর্থায়নব্যবস্থা সৃষ্টি করেনি, যেহেতু মুনাফা অর্জনের জন্য এর চেয়ে আরও বহু আকর্ষণীয় বিকল্প চারদিকে ছড়ানো আছে। সামাজিক ব্যবসা এটা অনায়াসে করতে পারে, যেহেতু এখানে ব্যক্তিগত মুনাফা অর্জনের কোনো শর্ত নেই। এটুকু পরিবর্তন হলে বেকারত্বহীন পৃথিবী সৃষ্টি করা সম্ভব হবে। বেকারত্ব মানুষের কোনো ব্যাধি নয়। এটা অর্থনৈতিক শাস্ত্রকারকদের ভুলের জন্য সৃষ্ট সমস্যা।
অর্থনীতি শাস্ত্রের মধ্যে এমন কোনো কথা জায়গা পাওয়ার কথা নয়, যেটা মানুষের উদ্যমকে নিরুৎসাহিত করতে পারে। অর্থনীতি শাস্ত্রের মূল কাজ হবে মানুষের শক্তির স্ফুরণের জন্য পথ খুলে দেওয়া, মানুষকে ক্রমাগতভাবে অধিকতর বড় মাপের হওয়ার জন্য আয়োজন করে দেওয়া। কিন্তু এখন হচ্ছে তার ঠিক উল্টো। আমরা এমন শাস্ত্র বানিয়েছি, যেখানে বিশাল মাপের প্রকৃত মানুষকে সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ করে রেখেছি। হাতি দিয়ে আমরা মাছি তাড়ানোর কাজ করাচ্ছি।
রাষ্ট্রের ওপর স্থায়ী নির্ভরশীলতা
রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব হলো সংকটাপন্ন নাগরিকদের আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকায় সাহায্য করা। উন্নত বিশ্বে এ দায়িত্ব পালন করা হয় আয়হীন এবং স্বল্প আয়ের মানুষকে মাসিক ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দিয়ে। কিন্তু রাষ্ট্রের আরেকটি প্রধান দায়িত্বের কথা আমরা এ প্রসঙ্গে ভুলে থাকি। গুরুত্বপূর্ণ এ দায়িত্বটা হলো প্রত্যেক নাগরিকের জন্য তার শক্তি বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া। এই সুযোগ সৃষ্টির ব্যাপারে যদি রাষ্ট্র দায়িত্ব পালনে উদ্যোগী হতো এবং সফল হতো, তবে কোনো নাগরিককে স্থায়ীভাবে রাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকার প্রয়োজন হতো না। এখন বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশে কিছু নাগরিক যে সারা জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে রাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীলতার মধ্যে, শুধু তা-ই নয়, বংশানুক্রমে এই নির্ভরশীলতা থেকে বের হতে পারছে না বা চাইছে না। এর কারণ রাষ্ট্র এদের নির্ভরশীলতার আওতায় আনতে অতিশয় তৎপর বটে, কিন্তু এদের নির্ভরশীলতার আওতা থেকে বের করে আনতে তার কোনো উৎসাহ দেখা যায় না। বেকারত্বের মতো এটাও মানুষের তৈরি একটা কৃত্রিম সমস্যা। বেকারত্ব থেকে মানুষকে বের করার পদ্ধতি বের করতে পারলেই একই পদ্ধতিতে ভাগ্যহীন মানুষের জন্য নতুন ভাগ্য সৃষ্টি করে তাদের রাষ্ট্রনির্ভরশীলতার আওতা থেকে বের হয়ে আসার সুযোগ দেওয়া যায়। রাষ্ট্রনির্ভরশীল একজন মানুষের জন্য রাষ্ট্রকে ওই ব্যক্তির পেছনে তার সারা জীবনে যে ব্যয় করতে হয়, তার একটি ভগ্নাংশ তাকে পুঁজি হিসেবে দিলেই সে কিন্তু স্থায়ীভাবে শুধু নির্ভরশীলতা থেকেই বের হয়েই আসবে না, সে আরও মানুষের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করবে, তার পরবর্তী বংশধরকে রাষ্ট্রের নির্ভরশীলতা থেকে মুক্ত রাখবে এবং সে নিজে করদাতা হিসেবে রাষ্ট্রের কোষাগারে অর্থ জোগান দেবে।
তাহলে এটা রাষ্ট্র করে না কেন? কারণ, রাষ্ট্রকে শাস্ত্রকারেরা বুঝিয়ে দিয়েছে যে এদের জন্য চাকরির ব্যবস্থা করতে না পারা পর্যন্ত তাদের খাইয়ে-পরিয়ে রাখতে হবে। চাকরি ছাড়া গতি নেই, এই যে মন্ত্র শাস্ত্রকারেরা আমাদের মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছে, এর থেকে আমরা বের হতে পারছি না। মানুষকে উদ্যোক্তা হিসেবে দেখতে আমাদের মনে অনীহা জমে গেছে।
কথাটা স্পষ্ট করার জন্য বলে রাখি, কারও মনে এমন কোনো ধারণার যেন জন্ম না নেয় যে রাষ্ট্রের সহায়তায় যারা জীবনধারণ করে, আমি তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে চাইছি। মোটেই তা চাইছি না। আমি শুধু তাদের মধ্যে এমন ব্যক্তিদের কথা বলছি, যারা আগ্রহ করে, দরখাস্ত করে রাষ্ট্রের নির্ভরশীলতা ছেড়ে এসে নিজের আয়ে নিজে চলতে চায়, তাদের জন্য সুযোগ সৃষ্টির কথা বলছি। যারা এখন যেভাবে আছে, সেভাবে থাকতে চায়, তারা সেভাবে থাকবে। নিজের আয়ে নিজে চলার বিষয়টি যাতে সবার কাছে আকর্ষণীয় ও বাস্তবসম্মত করা যায়, তার জন্য রাষ্ট্রকে সর্বতোভাবে চেষ্টা করতে হবে, কারণ মানুষের জীবন পরনির্ভরশীলতার জীবন হতে পারে না। মানুষ কর্মঠ জীব। সৃজনশীল জীব। মানুষের প্রকৃতিই হলো নিরন্তর নিজেকে বিকশিত করা, নিজের সম্ভাবনার সীমারেখাকে ক্রমাগতভাবে সম্প্রসারিত করা। অলস জীবন মানুষের স্বাভাবিকতাকে কেড়ে নেয়। পরনির্ভরশীলতা মানুষকে ক্ষুদ্র করে। তাই বেকারত্ব ও দারিদ্র্য এত অসহনীয়।
উপসংহার
প্রচলিত পুঁজিবাদী শাস্ত্র পৃথিবীর মৌলিক সমস্যা থেকে আমাদের মুক্তি দিতে পারবে না। এই কাঠামো অপরিবর্তিত রেখে অগ্রসর হলে আমাদের সমস্যাগুলোর সমাধান তো হবেই না; বরং এগুলো জটিলতর হয়ে আরও সমস্যার সৃষ্টি করবে। বড় মাপের প্রকৃত মানুষকে ছোট আকারের রোবট-প্রায় মানুষে পরিণত করে অর্থনীতি শাস্ত্র এ সমস্যার সৃষ্টি করেছে। প্রকৃত মানুষকে তার স্বাভাবিক সত্তাগুলো প্রকাশ করার সুযোগ দিলে বর্তমানে সৃষ্ট সমস্যাগুলোর সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে। মানুষের স্বার্থহীনতাকে অর্থনীতিতে স্বীকৃতি দিতে হবে। সামাজিক ব্যবসাকে শাস্ত্রীয় স্বীকৃতির মাধ্যমে এ উদ্যোগ শুরু হতে পারে। সামাজিক ব্যবসাকে স্বীকৃতি দিলে অর্থনীতিতে এটা কি কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় যেতে পারবে, নাকি একটা ক্ষুদ্র নামকাওয়াস্তে কর্মকাণ্ডে সীমাবদ্ধ হয়ে থাকবে—এ নিয়ে একটা প্রশ্ন উঠতে পারে। মানুষের মধ্যে যে স্বার্থহীনতা এবং সামগ্রিক মঙ্গলের জন্য কাজ করার যে প্রচণ্ড আগ্রহ ও ক্ষমতা, তা দেখলে মনে হয়, একবার সামাজিক ব্যবসা ব্যাপক পরিচিতি লাভ করলে এটা মহাশক্তিতে পরিণত হতে পারে। স্বার্থপরতা ও স্বার্থহীনতার দ্বন্দ্বে স্বার্থহীনতা অগ্রগামী হবে বলে আমার বিশ্বাস। নতুন প্রজন্মের তরুণদের দেখলে, বর্তমান সমাজ ও অর্থনীতি নিয়ে তাদের হতাশার কথা শুনলে আমার এ ধারণা আরও বদ্ধমূল হয়।
নতুন পৃথিবী সৃষ্টির সময় এসেছে। প্রযুক্তি আমাদের এ সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। আমাদের পথ বের করতেই হবে। সামাজিক ব্যবসা আমাদের মনে আশা জাগায়। হয়তো সামাজিক ব্যবসা আমাদের গন্তব্যে নিয়ে যেতে সক্ষম হবে। এ গন্তব্য হবে সবার জন্য ঋণ, সবার জন্য পুঁজি, সবার জন্য স্বাস্থ্য, সবার জন্য প্রযুক্তি, সবার জন্য সুশাসন, বেকারত্বহীন, দারিদ্র্যহীন, পরিবেশদূষণমুক্ত, যুদ্ধাস্ত্রমুক্ত, শান্তিপূর্ণ, আয়ের বৈষম্যহীন এক নতুন পৃথিবী।
লেখক: ড. মুহাম্মদ ইউনূস: শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ।
সূত্র: প্রথম আলো
তারিখ: নভেম্বর ১৯, ২০১৪
রেটিং করুনঃ ,