দুই বছরে টাকার মান কমেছে ২৩ শতাংশ
ডলার–সংকট কাটেনি। টাকার মানও কমছে। সরকারের আয় কম। এ কারণে সরকারকে ঋণের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। অন্যদিকে কমেছে বেসরকারি খাতের ঋণ। সব মিলিয়ে সংকট থেকে উত্তরণের পথে নেই দেশের অর্থনীতি। অর্থনীতিতে চাঞ্চল্য নেই। আবার সামনে আছে নির্বাচনকালীন অনিশ্চয়তা। ফলে গতি ফিরে পাচ্ছে না দেশের অর্থনীতি।
অথচ বিশ্বের অনেক দেশই মূল্যস্ফীতি কমাতে সফল হয়েছে। ধীরে ধীরে হলেও অর্থনীতির উত্তরণও ঘটছে অনেক দেশে। অথচ বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনো মন্থর হয়ে আছে। অর্থনীতির সূচকগুলোর মধ্যে রপ্তানি আয়ের দিক থেকে ভালো অবস্থানে বাংলাদেশ। প্রবাসী আয়ের প্রবৃদ্ধিতে ওঠা–নামা আছে। আমদানি কমেছে ঠিকই। একই সঙ্গে মূলধনি যন্ত্রপাতি, মধ্যবর্তী পণ্য এবং শিল্পের কাঁচামাল আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খোলা ও তা নিষ্পত্তি করার হার কমে গেছে অনেক বেশি। অর্থাৎ উৎপাদন খাত শ্লথ হয়ে রয়েছে।
তবে সবচেয়ে বড় সমস্যায় আছে দেশের সাধারণ মানুষ। মূল্যস্ফীতি এখনো দশের কাছাকাছি। গত দুই মাসে তা কমেছে খুবই সামান্য। তবে খাদ্য সূচকে মূল্যস্ফীতি বাড়ছেই। সীমিত আয়ের মানুষ কোনো না কোনো পণ্য নিয়ে বিপাকে থেকেই যাচ্ছে। যেমন মাছ-মাংস কিনতে না পেরে যাঁরা ডিমে থিতু হয়েছিলেন, তাঁদের অনেকের কাছেই এই পণ্যটিও নাগালের বাইরে যাচ্ছে। চালের দাম তো বাড়তি আছেই।
দুই বছরে টাকার মান কমেছে ২৩ শতাংশ
বাংলাদেশে গত দুই অর্থবছরে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে ২৩ শতাংশ। এর মধ্যে গত জুনে বিদায় হওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরেই টাকা অবমূল্যায়ন করা হয় ১৩ দশমিক ৭৬ শতাংশ। আর ২০২১-২২ অর্থবছরে টাকার মান কমেছিল ৯ দশমিক ২৫ শতাংশ। মূলত ডলার–সংকটের কারণেই টাকার মান ধরে রাখা যায়নি। আর এর প্রভাবেই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অর্ধেক কমে গেছে, লেনদেনের ভারসাম্যে দেখা দিয়েছে বড় ঘাটতি এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে দিশেহারা হয়েছে মানুষ।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক গবেষণা সংস্থা ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চের (এনবিইআর) দুজন অর্থনীতিবিদ বিস্তারিত গবেষণা করে বলেছেন, উঠতি অর্থনীতির দেশগুলোতে ডলারের মূল্যমান ১০ শতাংশ বাড়লে এক বছর পরে তাদের উৎপাদন কমে যাবে ১ দশমিক ৯ শতাংশ। আর এই উৎপাদন কমে যাওয়া অব্যাহত থাকবে আড়াই বছর। তবে উন্নত দেশগুলোতে ডলারের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব এতটা প্রকট হবে না। এসব দেশে ডলারের দর ১০ শতাংশ বাড়লে মাত্র এক প্রান্তিক পরে উৎপাদন কমবে দশমিক ৬ শতাংশ এবং এক বছরের মধ্যেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে। সুতরাং ডলারের মূল্যবৃদ্ধিতে সবচেয়ে বিপাকে আছে উঠতি অর্থনীতির দেশগুলোই।
গবেষণা অনুযায়ী, ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে উঠতি অর্থনীতির দেশগুলোর বাণিজ্য ও আর্থিক হিসাবেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। যেমন রপ্তানির তুলনায় আমদানি কমছে দ্বিগুণ হারে। এ ছাড়া দেশগুলোর ঋণমান খারাপ হচ্ছে, পুঁজিপ্রবাহ কমছে, মুদ্রানীতির সংকোচন হচ্ছে এবং শেয়ারবাজারেরও পতন ঘটছে। এমনকি এসব দেশ চলতি আয়ের ভারসাম্য নিয়েও হিমশিম খাচ্ছে। ডলারের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব নিয়ে গবেষকদের প্রতিটি কথাই বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হচ্ছে। সুতরাং মার্কিন দুই গবেষকের দেওয়া তত্ত্ব অনুযায়ী, বাংলাদেশেরও উৎপাদন কমার কথা। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এই গবেষণা ধরেই তৈরি করেছে তাদের বার্ষিক প্রতিবেদন ‘এক্সটারনাল সেক্টর রিপোর্ট’, যা গত ১৯ জুলাই প্রকাশিত হয়েছে।
কমছে বেসরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধি
করোনাভাইরাসের ধাক্কার পর অনেকেই ব্যবসা সম্প্রসারণসহ নানা উদ্যোগ নিয়েছিল। তবে চলতি বছর থেকে রাজনৈতিক পরিস্থিতি কিছুটা উত্তপ্ত হয়ে ওঠায় ব্যবসায়ীরা পরিকল্পনা পরিবর্তন করছেন। অনেকেই ঘোষণা দেওয়ার পর নতুন কারখানা তৈরি বন্ধ করেছেন। ফলে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে কমছে।
গত জুন শেষে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৫৭ শতাংশ। আগের মাস মে শেষে যা ছিল ১১ দশমিক ১০ শতাংশ। আর গত বছরের জুন শেষে প্রবৃদ্ধি ছিল ১৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ।
ব্যাংকাররা বলছেন, এখন ব্যবসায়ীরা নতুন করে কোনো প্রকল্প হাতে নিচ্ছেন না। বরং যাঁরা পরিকল্পনা করছিলেন, তাঁরাও সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করছেন। এ জন্য ব্যাংকগুলোতে চলতি মূলধন ঋণ ছাড়া অন্য ঋণ নেই। নির্বাচনের পরে পরিস্থিতি কী হয়, এরপরই সবাই সিদ্ধান্ত নেবেন।
পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ডলার–সংকট ও সামনের নির্বাচনের কারণে সবাই পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। এরপরই সবাই নতুন বিনিয়োগের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। এখন নতুন করে কোনো প্রকল্প নেওয়ার সময়ও না। এ জন্য ঋণের প্রবৃদ্ধি সেভাবে হচ্ছে না। আমরা গত সাত মাসে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছি। এর মধ্যে ৫০০-৬০০ কোটি টাকা ঋণ গেছে প্রকল্প সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়নে।
আমানতের চেয়ে ঋণের প্রবৃদ্ধি বেশি
২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে নির্দিষ্ট করে দেওয়ার পর আমানত ও ঋণের চিত্র পুরো উল্টে যায়। ব্যাংকগুলোতে যে পরিমাণ আমানত জমা হয়, তার চেয়ে বেশি ঋণ বিতরণ হয়। কোনো কোনো মাসে আমানতের দ্বিগুণও ঋণ বিতরণ হয়। গত জুন শেষে ব্যাংক খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি ছিল ৮ দশমিক ৪ শতাংশ। ওই মাসে ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ১৩ শতাংশ।
তবে জুলাই থেকে ঋণের সুদহার কিছুটা বাজারভিত্তিক করা হয়েছে। ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহার বাড়াচ্ছে। এর ফলে সামনে ব্যাংকগুলোতে আবার আমানত বাড়বে বলে আশা করছে ব্যাংকাররা।
এ ছাড়া ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ১ হাজার ৩৫৮ কোটি ডলার বিক্রি করে। প্রতি ডলার গড়ে ৯৫ টাকা হিসাবে গত বছরে ব্যাংকগুলো থেকে ১ লাখ ২৯ হাজার কোটি টাকা চলে যায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর ফলে অনেক ব্যাংকের তারল্য ব্যবস্থাপনা করা কঠিন হয়ে পড়ে। এক ব্যাংক অন্য ব্যাংক থেকে ১০ শতাংশ সুদেও টাকা ধার করে। এ কারণেও ঋণের প্রবৃদ্ধি চাহিদামতো হয়নি। পাশাপাশি কর ফাঁকি, ব্যাংকের ঋণের অর্থ ফেরত না দেওয়া এবং অর্থ পাচার—সবই বহাল রয়েছে।
বেড়েছে সরকারের ঋণ গ্রহণ
দেশ থেকে সরকার যেমন উচ্চ সুদের ঋণ নিচ্ছে, নিচ্ছে বিদেশ থেকে কম সুদের ঋণও। এ কারণে বাড়ছে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় ঋণ নেওয়ার হার অর্থাৎ ঋণ-জিডিপির হারও। ২০২২ সালের ৩১ মার্চ থেকে এ বছরের ৩১ মার্চ অর্থাৎ এক বছরে সরকার ঋণ নিয়েছে দুই লাখ কোটি টাকা। মার্চের পর আরও চার মাস পার হয়েছে, যে সময়ে সরকারের ঋণ আরও বেড়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের সূত্রগুলো জানায়।
ঋণনির্ভরতার কারণ হচ্ছে সরকারের আশানুরূপ আয় না হওয়া। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে, বিদায়ী অর্থবছরে অন্তত ৩৮ হাজার কোটি টাকা কম আদায় হয়েছে। বেশি ঋণ নেওয়ার আরেক কারণ ডলার–সংকট। সরকারের কাছে ডলার কম, বাজারেও কম। পরিস্থিতি সামাল দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার বিক্রি করছে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও কমছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী সরকার বিদায়ী অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেই ঋণ নিয়েছে ৯৭ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকা, বাকিটা নেয় বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকার যে ঋণ নেয়, তার বিপরীতে নতুন টাকা ছাপানো হয়। টাকা ছাপানোর প্রভাব পড়ে মূল্যস্ফীতিতে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাজারে যে উচ্চ মূল্যস্ফীতি আছে, তার পেছনের অন্যতম কারণ এ টাকা ছাপানো।
এমন সব পরিস্থিতি মাথায় নিয়েই গত বুধবার অর্থ বিভাগ প্রকাশ করেছে ডেট বুলেটিন, যাতে গত ৩১ মার্চ পর্যন্ত ঋণের সার্বিক চিত্র রয়েছে। অর্থ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী গত ৩১ মার্চ পর্যন্ত সরকারি মোট ঋণ ১৪ লাখ ৪৮ হাজার ৩৩৩ কোটি টাকা, যা এর তিন মাস আগে অর্থাৎ ২০২২ সালের ডিসেম্বরেও ছিল ১৩ লাখ ৫৯ হাজার ৮৯৮ কোটি টাকা। আর ঠিক এক বছর আগে ২০২২ সালের ৩১ মার্চ এ ঋণ ছিল ১২ লাখ ৪৯ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা। ঋণের অর্থে সরকার দৈনন্দিন খরচ চালানোর পাশাপাশি আগে নেওয়া ঋণের সুদও পরিশোধ করেছে।
অর্থ বিভাগ বলছে, ২০২২ সালের ৩১ মার্চ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় দেশের ঋণের হার ছিল ৩১ দশমিক ৪২ শতাংশ। ২০২৩ সালের ৩১ মার্চ তা বেড়ে হয়েছে ৩২ দশমিক ৫৫ শতাংশ। অর্থ বিভাগ এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) একটি হারকে মানদণ্ড মেনেছে। প্রতিবেদনে বলেছে, আইএমএফের মতে জিডিপির অন্তত ৫৫ শতাংশ ঋণ নেওয়া যায়। সে হিসেবে আরও ঋণ নেওয়ার সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশের।
তবে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, আইএমএফ যে হারকে মেনে নেয়, সে তুলনায় বাংলাদেশের ঋণ জিডিপি অনুপাত ঠিকই আছে। কিন্তু কর-জিডিপির প্রায় চার গুণ বেশি এখন ঋণ-জিডিপি অনুপাত। আর এটাই অস্বাভাবিক। প্রথম আলোকে তিনি আরও বলেন, ‘জিডিপির দিকে তাকিয়ে খুব লাভ নেই। এটা দিয়ে তেমন কিছু হয় না। আমাদের বুঝতে হবে যে অর্থনীতির ৮৮ শতাংশ বেসরকারি খাতের, বাকিটা সরকারি খাতের। বেসরকারি খাতকে সরকারকে কতটা স্বস্তি দিচ্ছে, কতটা কষ্ট কম দিচ্ছে, কতটা সুযোগ করে দিচ্ছে—তার ওপর নির্ভর করবে দেশের অর্থনীতি কতটা ভালো থাকবে।’
আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘ঋণ-জিডিপি ১০০ শতাংশের বেশি হলেও সমস্যা হয় না, যদি কর-জিডিপির হার ভালো থাকে। চোখের সামনে কর-জিডিপির হার ভালো হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি না।’
রেটিং করুনঃ ,