কোভিডের ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে বিশ্বের সব দেশ। ২০২১ সালে সবারই কমবেশি ভালো প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এবারের মন্দার বিশেষ দিক হলো, উন্নত দেশগুলো উন্নয়নশীল দেশগুলোর চেয়ে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে এগিয়ে আছে। এর আগে ২০০৭-২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের সময় ঠিক তার উল্টোটা ঘটেছিল।
ওইসিডিভুক্ত (ধনী দেশগুলোর জোট) ৩৮টি দেশের মোট দেশজ উৎপাদন প্রাক্-মহামারি সময়কে ছাড়িয়ে গেছে। ২০২১ সালের শেষ প্রান্তিকে এ দেশগুলোর বেকারত্বের হার ছিল ৫ দশমিক ৭ শতাংশ, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালের বেকারত্বের গড় হারের সমান। শুধু তাই নয়, এ দেশগুলোর পারিবারিক আয় এখন মহামারির আগের সময়ের চেয়ে বেশি।
দ্য ইকোনমিস্ট সম্প্রতি বিশ্বের ধনী দেশগুলোর অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার নিয়ে সমীক্ষা চালিয়েছে। সেখানে এ চিত্র উঠে এসেছে। তবে সব দেশ একইভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। শঙ্কার কারণ হলো, তাদের মধ্যকার এ ব্যবধান আরও বাড়বে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
দ্য ইকোনমিস্ট ধনী দেশগুলোর অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের অবস্থা বুঝতে পাঁচটি সূচক ব্যবহার করেছে—মোট দেশজ উৎপাদন (জিপিডি), পারিবারিক আয়, স্টক মার্কেটের অবস্থা, মূলধন ব্যয় ও সরকারি ঋণ। ২৩টি দেশের এসব তথ্য বিশ্লেষণ করে তারা দেখিয়েছে, সবচেয়ে এগিয়ে আছে ডেনমার্ক। স্লোভেনিয়া, সুইডেন, নরওয়ে, চিলি—এরাও ওপরের সারিতে আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও মন্দ করেনি। ২৩টি দেশের মধ্যে তারা আছে দশম স্থানে। আবার জার্মানি, ব্রিটেন ও জাপানের মতো দেশ আছে পেছনের সারিতে।
তবে যেসব দেশ বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে বেশি যুক্ত, তাদের ক্ষতি হয়েছে বেশি, ফলে পুনরুদ্ধারে তারা কিছুটা পিছিয়ে।
কোভিড মোকাবিলা
মূল বিষয় হচ্ছে সরকার কীভাবে কোভিড মোকাবিলা করেছে, তার ওপরই নির্ভর করছে পুনরুদ্ধার। অনেক দেশ মানুষের হারানো আয় পুষিয়ে দিতে বিপুল অঙ্কের নগদ অর্থ প্রণোদনা দিয়েছে। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে সবার আগে। ২০২০ ও ২০২১ সালে তিন দফায় প্রণোদনা দিয়েছে তারা—সব মিলিয়ে দুই লাখ কোটি ডলারের বেশি। প্রণোদনা চেক থেকে শুরু করে বেকার ভাতার আওতা বৃদ্ধিসহ নানা ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে তারা। কানাডাও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পথ অনুসরণ করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের গৃহীত নীতিমালায় দেখা যায়, সেখানে একদিকে আছে বেকারত্ব ভাতার পরিমাণ ও মেয়াদ বাড়ানো, অন্যদিকে আছে ঋণের মাধ্যমে ছোট ব্যবসাগুলোকে কর্মসংস্থান না কমাতে উৎসাহিত করা। কিন্তু ইউরোপের তিনটি দেশেই ছাঁটাই বন্ধে কর্মীদের বেতনের একটা বড় অংশ প্রণোদনা হিসেবে দেওয়া হয়েছে। ওই দেশগুলোতে বেকারত্ব ভাতার মেয়াদ বাড়ানোর ব্যবস্থাও করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রাথমিকভাবে বেকারত্ব ভাতার মেয়াদ ছিল ২০২০ সালের জুলাই মাসের শেষ পর্যন্ত বাড়ানো হয়। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, সেই সময়ের মধ্যে অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার হওয়ার সম্ভাবনা কম। সেই সময়ের পর ভাতার মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়টি দলীয় রাজনীতিতে আটকে গেল ও মেয়াদ শেষ হয়ে গেল। অবশ্য এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা উচিত যে সেখানে দরিদ্রদের জন্য বিদ্যমান খাদ্য সহায়তা কার্যক্রমের জন্য বরাদ্দ বাড়ানো হয় এবং করোনাকালে (২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত সময়ে) তার সুবিধা পাওয়া মানুষের সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। অন্যদিকে ইউরোপের অনেক দেশেই বেকার ভাতার মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া কর্মী ছাঁটাই রোধের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব ব্যয়ের পরিমাণ (জিডিপির শতাংশ হিসেবে) ইউরোপের তিনটি দেশের চেয়ে অনেক বেশি। মূল পার্থক্য হচ্ছে প্রণোদনার অর্থ ব্যয়ের ধরনে। যুক্তরাষ্ট্রে বেশি জোর দেওয়া হয়েছে ব্যবসায় সহায়তা দেওয়ার ওপর। ব্যবসা বাঁচলে চাকরি বাঁচবে—এ অর্থে। আর ইউরোপের দৃষ্টি সরাসরি কর্মসংস্থানের ওপর।
তবে বেকারত্ব বৃদ্ধি ও কর্মী ছাঁটাই রোধে ইউরোপের দেশগুলো সফলতা দেখালেও তারা অর্থনৈতিক সংকট পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি। ভাইরাসটির দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আবারও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অন্যদিকে আর্থিক প্রণোদনা দীর্ঘকাল চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে নীতিনির্ধারকদের মধ্যে অস্বস্তি দেখা যাচ্ছে। তাদের ভয়, ঋণের বোঝা বেড়ে অসহনীয় পর্যায়ে চলে যায় কি না।
এদিকে মানুষের হাতে প্রণোদনার অনেক টাকা জমে যায়। গত বছর বিধিনিষেধ উঠে গেলে মানুষ হাত খুলে ব্যয় করতে শুরু করে। এতে মূল্যস্ফীতি আকাশ ছুঁয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভোক্তা মূল্যস্ফীতি এখন ৪২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। সব দেশেই কমবেশি একই অবস্থা। এ অবস্থায় প্রণোদনা বন্ধ করে তারা এখন সুদহার বৃদ্ধির পথে হাঁটতে শুরু করেছে। কিন্তু অর্থনীতিবিদদের শঙ্কা, এতে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার আরও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশের প্রণোদনা
বাংলাদেশও কোভিড মোকাবিলায় জিডিপির ৪ শতাংশের ওপরে প্রণোদনা দিয়েছে। কিন্তু উন্নত দেশগুলো যেখানে ব্যবসা বাঁচানোর পাশাপাশি মানুষকে সরাসরি নগদ প্রণোদনা দিয়েছে, দেশে সেটা তেমন একটা হয়নি। তবে ৫০ লাখ দরিদ্র মানুষকে দুবার সরাসরি আড়াই হাজার টাকা দেওয়ার উদ্যোগ নেয় সরকার, কিন্তু প্রয়োজনীয় তথ্যের অভাবে সবাইকে তা দেওয়া যায়নি। আর দেশে দেওয়া হয়েছে মূলত ঋণ। বড় বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এ প্রণোদনার ঋণ পেয়ে ভালোভাবে ঘুরে দাঁড়ালেও ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাত পিছিয়ে আছে। তাদের জন্য যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, তা–ও পুরোপুরি বিতরণ করা যায়নি নথিপত্রের সমস্যার কারণে। কিন্তু দেশের বেশির ভাগ মানুষের কর্মসংস্থান এ খাতে। এ পরিস্থিতিতে মানুষের আয় কমেছে।
চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে অমিক্রনের কারণে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি কমতে পারে। কিন্তু অমিক্রনের ধার কমে আসছে। ইকোনমিস্ট মনে করছে, বছরের বাকি তিন প্রান্তিকে যে প্রবৃদ্ধি হবে, তাতে ক্ষতি পুষিয়ে যাবে।
বিজ্ঞাপন
দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, চলতি বছর সবচেয়ে এগিয়ে থাকা তিনটি দেশের সামগ্রিক জিডিপি মহামারির আগের সময়ের চেয়ে ৫ শতাংশ বেশি হতে পারে। যারা নিচের দিকে আছে, তাদেরও বাড়বে, তবে মাত্র ১ শতাংশ। অর্থাৎ বৈষম্য বাড়বে।
সূত্রঃ প্রথম আলো।
তারিখঃ ফেব্রুয়ারী ১৫, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,