মহামারির এক বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। অনেক মানুষ এখনো মারা যাচ্ছে এবং কোটি কোটি মানুষ বেকারত্বের অভিশাপ বয়ে বেড়াচ্ছে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক চাপ এখনো প্রবল। তা সত্ত্বেও এই দুরবস্থা থেকে বেরোনোর পথ ক্রমশ আমাদের সামনে দৃশ্যমান হচ্ছে। অকূল সাগরে দিগ্ভ্রান্ত নাবিকদের দূরে দ্বীপের গাছপালা দেখলে যেমন অনুভূতি হয়, আমাদেরও এখন সে রকম হচ্ছে।
বিজ্ঞানীদের ধন্যবাদ, তাঁদের কল্যাণে লাখ লাখ মানুষ টিকা পাচ্ছেন। অর্থনীতিও নানাভাবে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে। পুনরুদ্ধারের গতি প্রত্যাশার চেয়ে বেশি মনে হচ্ছে। আইএমএফের সর্বশেষ অর্থনৈতিক পূর্বাভাসে আমরা দেখিয়েছি, এ বছর বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়াবে ৬ শতাংশ। ২০২২ সালে তা দাঁড়াবে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ।
তবে এটা মনে করার কারণ নেই যে আমরা সব চ্যালেঞ্জ পার করে এসেছি। অনেক দেশেই ভাইরাস আরও শক্তিশালী রূপে আবির্ভূত হচ্ছে, অনেক দেশ এখনো টিকা পাচ্ছে না, ফলে পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়াও সবখানে একই রকম হবে না। এমনকি এক দেশের মধ্যেও সব খাতের পুনরুদ্ধার একই গতিতে হচ্ছে না। যেসব দেশে টিকাদানের গতি কম, অর্থনীতিতে নীতিগত সমর্থন দুর্বল ও যারা পর্যটনের ওপর বেশি নির্ভরশীল, তারা পুনরুদ্ধারে পিছিয়ে আছে।
আমরা যে চলতি বছরের ইতিবাচক পূর্বাভাস দিয়েছি, তার মূল চালিকা শক্তি কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলো নয়, বরং উন্নত দেশগুলো। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথা বলতে হয়, নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি ডলারের প্রণোদনা প্যাকেজের বদৌলতে চলতি বছর দেশটির প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়াতে পারে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। উন্নত দেশগুলোর মধ্যে অবশ্য ইউরো অঞ্চলের প্রবৃদ্ধির হার এত বেশি হবে না। অন্যদিকে উদীয়মান ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে চীন এ বছর ভালো করবে। তাদের প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়াতে পারে ৮ দশমিক ৪ শতাংশ। চীনের প্রবৃদ্ধির হার ইতিমধ্যে মহামারি-পূর্ব সময়ে ফিরে গেলেও উদীয়মান বড় অর্থনীতিগুলোর সে জায়গায় ফেরত যেতে ২০২৩ সাল লেগে যাবে।
এই যে দেশে দেশে এত ব্যবধান, তার অবধারিত ফল হলো, এই সব দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মানে বড় ধরনের পার্থক্য সৃষ্টি হবে। মহামারি-পূর্ব সময়ের প্রক্ষেপণের সঙ্গে তুলনায় নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে মাথাপিছু জিডিপি হ্রাসের হার দাঁড়াবে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ এবং উদীয়মান দেশগুলোতে ২ দশমিক ৩ শতাংশ। এতে দারিদ্র্য বিমোচনের সফলতা অনেকটাই ম্লান হবে। মহামারি-পূর্ব সময়ের প্রক্ষেপণের তুলনায় ৯ কোটি ৫০ লাখ অতিরিক্ত মানুষ চরম দারিদ্র্যের কাতারে নেমে আসবে।
এ তো দেশে আন্তর্দেশীয় পরিস্থিতি, এখন দেখা যাচ্ছে, দেশের ভেতরেও ব্যবধান বাড়ছে। বিশেষ করে তরুণ ও স্বল্প দক্ষতার শ্রমিকেরা অন্যদের তুলনায় বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। নারীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, বিশেষ করে উদীয়মান ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে।
এদিকে মহামারির কারণে চলমান ডিজিটালাইজেশন প্রক্রিয়া আরও গতি পেয়েছে। ততে হচ্ছে কী, যেসব কাজ ইতিমধ্যে মানুষের হাত থেকে যন্ত্রের কাছে চলে গেছে, সেই কাজগুলোর ফেরত আসার সম্ভাবনা আরও কমে যাবে। তখন এক খাতের কর্মীদের আরেক খাতে যেতে হবে। তাঁদের নতুন দক্ষতা আয়ত্ত করতে হবে। এতে অনেকের আয় কমে যাবে।
তবে সারা বিশ্ব যেভাবে এই মহামারিতে নীতিগতভাবে সাড়া দিয়েছে, তাতে ক্ষতিবৃদ্ধি এড়ানো গেছে। সামগ্রিকভাবে বিভিন্ন দেশের সরকার ১৬ লাখ কোটি ডলারের রাজস্ব সহায়তা নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। আমাদের হিসাব হচ্ছে, এই সহায়তা করা না হলে গত বছর ক্ষতি তিন গুণ বৃদ্ধি পেত।
এই প্রক্রিয়ায় আর্থিক সংকট এড়ানো গেছে। ২০০৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের তুলনায় মধ্যমেয়াদি ক্ষতি কম হবে। সেবার উন্নত দেশগুলো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এবার উদীয়মান ও উন্নয়নশীল দেশগুলোই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
তবে আমাদের এই পূর্বাভাস একদম কণ্টকমুক্ত নয়। বড় ধরনের অনিশ্চয়তা আছে আমাদের এই পূর্বাভাস ঘিরে। তবে দ্রুতগতিতে টিকা দেওয়া গেলে আমাদের পূর্বাভাসের গ্রাফ আরও ঊর্ধ্বমুখী হবে, এমন আশাবাদ করাই যায়। কিন্তু শঙ্কা হচ্ছে, ভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট টিকার অ্যান্টিবডি বাইপাস করে যাচ্ছে বলে যে খবর পাওয়া যাচ্ছে, তাতে মহামারি যেমন দীর্ঘায়িত হতে পারে, তেমনি গ্রাফও নিম্নমুখী হতে পারে। এ ছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সুদহার বেড়ে গেলে বিভিন্ন ধরনের আর্থিক ঝুঁকি সৃষ্টি হতে পারে। এতে সম্পদমূল্য বেড়ে গিয়ে বিশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি হতে পারে। আর্থিক খাতে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়ে অর্থায়ন প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া গতি হারাবে। বিশেষ করে অতি সহায়তাপ্রাপ্ত উদীয়মান বাজার ও উন্নয়নশীল দেশের প্রেক্ষাপটে এটি সত্য।
লেখক: আইএমএফ ব্লগ থেকে নেওয়া, গীতা গোপীনাথ: আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রধান অর্থনীতিবিদ। অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন।
সূত্র: প্রথম আলো
তারিখ: এপ্রিল ১২, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,