লেখক:শওকত হোসেন।
নোবেল পাওয়ারও বেশ আগে মুহাম্মদ ইউনূসের বিভিন্ন সময়ে দেওয়া বক্তৃতার একটা সংকলন বের হয়েছিল। শিরোনাম ছিল, ‘পথের বাধা সরিয়ে দিন, মানুষকে এগোতে দিন’। তখন মুহাম্মদ ইউনূসের পরিচয় তিনি অর্থনীতির শিক্ষক ছিলেন, তবে শিক্ষকতা ছেড়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন ক্ষুদ্রঋণ বিতরণের প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংক। তখন তিনি এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)। বইটি বেশ সাড়া ফেলেছিল। সাধারণ মানুষের শক্তির জায়গাটা নিয়ে এর আগে কেউ এভাবে বলেননি।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস সেখানে লিখেছিলেন, সাধারণ মানুষের শক্তিই রাষ্ট্রের মূল শক্তি। প্রত্যেক মানুষ সীমাহীন সম্ভাবনার আধার। সে মানুষ দরিদ্রতম পরিবারের সদস্যই হোক, কি নিকৃষ্টতম বস্তির বাসিন্দাই হোক। যে সমাজ যত বেশি মানুষের যত বেশি পরিমাণ সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপায়িত করতে পারবে, সে সমাজ তত বেশি শক্তিশালী হবে। সে সমাজই দ্রুত নিজেদের পরিবর্তন করতে পারে, যে সমাজ জ্ঞান, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং সুদক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে প্রতিটি মানুষকে এমন অবস্থানে নিয়ে যেতে পারছে, যেন প্রত্যেকে নিজের অন্তর্নিহিত সম্ভাবনাকে প্রকাশ করার সুযোগ পায়। এই সুযোগ মানুষ পায় যদি সরকারের ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি মানুষের সেবামুখী হয়, রাষ্ট্রীয় নীতিমালা আত্মবিশ্বাসে বিশ্বাসী হয়, শিক্ষাব্যবস্থা সর্বজনীন হয়, কর্মমুখী ও স্বনির্ভরতামুখী হয়, প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজনসমূহ সব মানুষের বিকাশের সহায়ক হয়।
বইটির একটি উপশিরোনাম ছিল, ‘বাংলাদেশ গরিব দেশ নয়, মানবসম্পদ ব্যবহারে ব্যর্থ দেশ’। সেখানে তিনি লিখেছিলেন, ‘দেশের দারিদ্র্য বিশেষ ব্যর্থতার ফলে সৃষ্ট একটি পরিস্থিতি মাত্র। দেশ হিসেবে গরিব দেশ হওয়ার প্রধান দায়িত্ব দেশের নীতিনির্ধারকদেরই গ্রহণ করতে হবে। আমরা আমাদের বুদ্ধির দোষে, নীতির দোষে নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন করতে পারছি না—এ কথা মেনে নিতে হবে। এর ওর ষড়যন্ত্র বলে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টাটা হাস্যকর ব্যর্থ প্রয়াস মাত্র। “গরিব দেশ” বলে বর্ণনা না করে আমরা আমাদের দেশকে “মানবসম্পদ ব্যবহারে ব্যর্থ দেশ” হিসেবে বর্ণনা করলেই আসল কথাটা সরাসরি বলা হবে। এতে আমাদের করণীয়গুলোও পরিষ্কার হয়ে যাবে। উন্নয়ন উদ্যোগগুলোর মূল লক্ষ্য কি হওয়া উচিত, সেটাও স্পষ্ট হবে।’
শান্তিতে নোবেল
বিশ্বজুড়েই তখন গ্রামীণব্যাংকের সুনাম। ক্ষুদ্রঋণের প্রসার ঘটেছে সারা দেশে। গ্রামীণ ব্যাংক মডেল জনপ্রিয় হচ্ছিল অন্য দেশেও। সব মিলিয়ে ক্ষুদ্রঋণের জনক হিসেবে বাংলাদেশের সুনাম তখন বিশ্বব্যাপী। তিনি বলতেন, দরিদ্র মানুষের ঋণ পাওয়া অধিকার। তখন তো বাংলাদেশ মানেই ছিল বন্যার প্রকোপ, দুর্নীতিগ্রস্ত, সাহায্যনির্ভর একটি দেশ, যে দেশের নাগরিকের বড় অংশই চরম দরিদ্র। সেই বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে আরেকবার মুখ উজ্জ্বল করেছিলেন মুহাম্মদ ইউনূস। দিনটি ছিল ২০০৬ সালের ১৩ অক্টোবর। যখন নরওয়ের নোবেল পিস প্রাইজ কমিটি ঘোষণা করে যে সেই বছরের নোবেল শান্তি পুরস্কার পাচ্ছেন বাংলাদেশের মুহাম্মদ ইউনূস ও তাঁর প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক। সংবাদটি ছড়িয়ে পড়েছিল বিদ্যুৎবেগে। ওই বছরের ১০ ডিসেম্বর নরওয়ের রাজধানী অসলোতে নোবেল শান্তি পুরস্কার গ্রহণ করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিনিধি হিসেবে তাসলিমা বেগম।
নোবেল কমিটি এ নিয়ে বলেছিল, ‘মুহাম্মদ ইউনূস এবং গ্রামীণ ব্যাংক পরস্পরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে। বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠী যদি দারিদ্র্যের বৃত্ত ভেঙে ফেলার উপায় খুঁজে না পায়, তাহলে স্থায়ী শান্তি অর্জিত হতে পারে না। ক্ষুদ্রঋণ হলো এ রকমই এক উপায়। মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর স্বপ্নকে বাস্তব পদক্ষেপের মাধ্যমে রূপ দিতে সক্ষম হয়েছেন, তা থেকে লাভবান হয়েছে লাখ লাখ মানুষ। মুহাম্মদ ইউনূস ক্ষুদ্রঋণকে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ক্রমেই এক গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার করে তুলেছেন। ইউনূস আর গ্রামীণ ব্যাংক দেখিয়েছে যে দরিদ্রতম ব্যক্তিরাও তাদের নিজেদের উন্নতি অর্জন করতে সক্রিয় হতে সক্ষম। যে সমাজে বিশেষ করে মেয়েদের নিগ্রহমূলক সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার বিরুদ্ধে যুঝতে হয়, সেই সমাজে ক্ষুদ্রঋণ মুক্তির এক গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে দেখা দিয়েছে।’
নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করে বক্তৃতায় মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, তিনি বিশ্বাস করেন সবার যৌথ উদ্যোগই পারে একটি দারিদ্র্যমুক্ত বিশ্ব তৈরি করতে, যেখানে দারিদ্র্য থাকবে জাদুঘরে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস এখন আর গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে নেই। এখন তিনি করছেন সামাজিক ব্যবসা নিয়ে। তিনি বলছেন, এটি তাঁর জন্য লক্ষ্যে পৌঁছানোর পথ। সামাজিক ব্যবসার ধারণাটিও সম্প্রসারিত হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।
বেড়ে ওঠা
চট্টগ্রামের এক স্বর্ণ ব্যবসায়ী পরিবারে জন্ম মুহাম্মদ ইউনূসের, ১৯৪০ সালের ২৮ জুন। চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় মুহাম্মদ ইউনূস মেধাতালিকায় ১৬তম স্থান অধিকার করেন এবং চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হন। ১৯৫৭ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন। সেখান থেকেই স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন তিনি। ১৯৬২ সালে চট্টগ্রাম কলেজে প্রভাষক পদে যোগ দেন এবং ১৯৬৫ সালে ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যান। মুহাম্মদ ইউনূস পূর্ণ বৃত্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভেন্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৯ সালে অর্থনীতিতে পিএইচডি লাভ করেন। বাংলাদেশে ফিরে আসার আগে ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত মিডল টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের পক্ষে বিদেশে জনমত গড়ে তোলা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা প্রদানের জন্য সাংগঠনিক কাজে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৭২ সালে দেশে ফিরে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন এবং বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সালে তিনি অধ্যাপক পদে উন্নীত হন এবং ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত এ পদে কর্মরত ছিলেন।
গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠা
দারিদ্র্য নিয়ে মুহাম্মদ ইউনূস কাজ শুরু করেন ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষের সময়। স্বল্প পরিমাণে ঋণ দেওয়ার কথা তখনই তিনি ভাবতে শুরু করেন। ১৯৭৪ সালেই মুহাম্মদ ইউনূস তেভাগা খামার প্রতিষ্ঠা করেন। অর্থনীতির তত্ত্ব আর বাস্তব পরিস্থিতির মধ্যকার ফারাকও তাঁকে তখন ভাবিয়ে তুলেছিল। তত্ত্ব ও বাস্তব পরিস্থিতি পার্থক্য দূর করার ভাবনা থেকেই গ্রামীণ ব্যাংক ধারণার উদ্ভব ও বিকাশ। ১৯৭৬ সালে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসসংলগ্ন জোবরা গ্রামে পরীক্ষামূলকভাবে শুরু করেন ‘গ্রামীণ ব্যাংক প্রকল্প’।
মুহাম্মদ ইউনূস ও অ্যালান জলিসের লেখা ‘ব্যাংকার টু দ্য পুওর: মাইক্রো লেন্ডিং অ্যান্ড দ্য ব্যাটল অ্যাগেইনস্ট ওয়ার্ল্ড পভার্টি’ বইতে এ নিয়ে লেখা আছে, ‘সে সময় সুদের হার ছিল সপ্তাহ বা দৈনিক ভিত্তিতে ১০ শতাংশ পর্যন্ত। তখন চট্টগ্রামের জোবরা নামক গ্রামে যাঁরা এই চড়া হারে সুদের কারবারিদের কাছ থেকে টাকা ধার নিতেন, তিনি নিজের শিক্ষার্থীদের নিয়ে তাঁদের একটি তালিকা তৈরি করেন। ড. ইউনূস বিনা সুদে তাঁদের ঋণ দিতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। তবে এই ক্ষণস্থায়ী ব্যবস্থা সমস্যার সমাধান দিতে পারে না।
তাই তিনি স্থানীয় জনতা ব্যাংকের শাখায় গিয়ে শাখার ব্যবস্থাপককে এই দরিদ্র মানুষকে অল্প পরিমাণে অল্প হারে ঋণ দেওয়ার অনুরোধ করেছিলেন। তবে ব্যাংক ব্যবস্থাপক অপারগতা জানান, কেননা লোকজন অশিক্ষিত বলে প্রয়োজনীয় ফরম পূরণ করতে পারবেন না এবং ঋণের টাকা ফেরত পাওয়ার নিশ্চয়তাও ছিল না। তখন মুহাম্মদ ইউনূস ব্যাংককে নতুন এক প্রস্তাব দিলেন। বললেন, ঋণগ্রহীতারা যদি অর্থ ফেরত না দেয়, তাহলে তিনি নিজে তা পরিশোধ করবেন। এভাবেই ঋণ দেওয়া শুরু। মূলত তিনিই ব্যাংক থেকে নিজের দায়িত্বে ঋণ করে মানুষকে অল্প অল্প করে সেগুলো পুনরায় ঋণ দিতেন। এভাবেই ক্ষুদ্রঋণ বিষয়টিকে তিনি সামনে নিয়ে আসেন।
জনতা ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া এবং দেওয়ার পর এটাকে একটি স্থায়ী রূপ দিতে চাইলেন। তাঁর এই উদ্যোগকে ১৯৭৯ সালের ৬ জুন বাংলাদেশ ব্যাংক একটি প্রকল্প হিসেবে গ্রহণ করে। প্রকল্পটি চলে ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত। পরে ১৯৮৩ সালের ৪ সেপ্টেম্বর গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ, ১৯৮৩ জারি করে একে ব্যাংক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে সরকার। গ্রামীণ ব্যাংকের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৮৩ সালের ২ অক্টোবর।
সামাজিক ব্যবসা
প্রতিষ্ঠার পর থেকেই মুহাম্মদ ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১১ সালে আদালতের রায়ের পর তিনি পদত্যাগ করেন। নিজের নামে করা ‘ইউনূস সেন্টার’ থেকেই সব ধরনের কাজ পরিচালনা করেন মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি এখন সামাজিক ব্যবসার ধারণা ছড়িয়ে দিচ্ছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। তাঁর জন্মতারিখ ২৮ জুন। এই দিনটিতে বৈশ্বিকভাবে পালন করা হয় সামাজিক ব্যবসা দিবস হিসেবে। তিনি মূলত বর্তমান পৃথিবীকে নিরাপদ করতে হলে ‘তিন শূন্য থিওরি’ বাস্তবায়ন করার কথা বলছেন। তাঁর বক্তব্য হচ্ছে, ‘পৃথিবীকে নিরাপদ করতে হলে আমাদের দরিদ্র্যতা, বেকারত্ব এবং কার্বন নিঃসরণ (থ্রি জিরো-জিরো পভার্টি, জিরো আন এমপ্লয়মেন্ট, জিরো কার্বন) শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে হবে। এ তিনটি বিষয় বাস্তবায়ন করা গেলে পৃথিবীকে নিরাপদ করা যাবে। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সুন্দর পৃথিবী গড়ে তোলা সম্ভব হবে।’
মুহাম্মদ ইউনূস প্রচলিত ধারার অর্থনীতিবিদ নন। তিনি কেবল তাত্ত্বিক আলোচনার মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। বাস্তবায়ন করেছেন, আবার নতুন তত্ত্বের কথা বলেছেন, তা বাস্তবায়নেরও পথ দেখাচ্ছেন। ড. ইউনূস বিশ্বে বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন, দেখিয়েছেন নতুন পথ, তিনি বাংলাদেশের অর্থনীতির অগ্রযাত্রার অন্যতম অগ্রনায়ক।
সূত্র: প্রথম আলো।
তারিখ: এপ্রিল ২৪, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,