লেখক:সানাউল্লাহ সাকিব।
কৃষকের মাঠ পেরিয়ে সবজি এখন বাড়ির ছাদে। পাশাপাশি ফ্ল্যাটের বারান্দায় ও ফাঁকা জায়গায়। আর সবজি মৌসুম এখন পুরো বছরজুড়ে। ফলে পুষ্টি চাহিদা মিটছে সবার। তবে দুই দশক আগেও সবজি মৌসুম ছিল শীতকালের তিন-চার মাস। আর সবজির তালিকায় ছিল হাতে গোনা কয়েকটি। আর চাষ হতো শুধু কৃষকের মাঠে।
বছরজুড়ে সবজি উৎপাদন ও নতুন সবজির ফলনে যে প্রতিষ্ঠানের নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে, সেটি হলো লাল তীর সীড লিমিটেড। পাঠকদের যাঁরা গ্রামে বা শহরে একবার হলেও সবজি রোপণ করেছেন, মনে করে দেখেন, তার বেশির ভাগই ছিল লাল তীরের বীজ। লাল তীরের পর এখন আরও বড় করপোরেট গ্রুপ ও প্রতিষ্ঠান এ ব্যবসায় এসেছে। তবে লাল তীর এখনো সবজি বীজের পথপ্রদর্শক। আর সবজি বীজের বাজারের বড় অংশ এখনো লাল তীরের।
শুরুটা যেভাবে
লাল তীরের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৯৫ সালে। টঙ্গী এলাকায় জমি কিনে বীজ নিয়ে গবেষণা ও পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু করে এটি। শুরুতে লাল তীর ইস্ট পরিচিত ছিল ওয়েস্ট সিড নামে। ২০০৭ সালে নাম পরিবর্তন হয়ে লাল তীর হয়। শুরু থেকে সবজির বীজের উন্নয়ন, উৎপাদন ও বিক্রির সঙ্গে জড়িত ছিল এ প্রতিষ্ঠান।
লাল তীর এখন পর্যন্ত ৩২ ধরনের সবজির বীজ উৎপাদন ও বাজারজাত করছে। শুধু দেশে নয়, বীজ রপ্তানি করছে বিদেশেও। দেশের বাইরে আফ্রিকায়ও কৃষকদের নিয়ে নতুন ধরনের বীজ উৎপাদন ও বীজের উন্নয়নে কাজ করছে লাল তীর। আর এসব কার্যক্রমে লাল তীর সহায়তা নিচ্ছে দেশি-বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়, বীজ উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত বিশ্বসেরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের।
লাল তীরের এমন সফলতা কিন্তু গোপন নেই। ‘একসেস টু সিড ইনডেক্স’ তালিকায় দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে লাল তীর সীডের অবস্থান সপ্তম, গত ২২ নভেম্বর যা প্রকাশ করা হয়। আগে লাল তীরের অবস্থান ছিল ১৩তম। একসেস টু সিড ইনডেক্স প্রকাশ করা হয় নেদারল্যান্ডসের একসেস টু সিড ফাউন্ডেশন থেকে, যা একটি অলাভজনক ও স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। লাল তীরের এমন স্বীকৃতি এসেছে কয়েকটি কারণে। তার মধ্যে রয়েছে বীজ নিয়ে বাংলাদেশ ও নেপালে গবেষণা ও উন্নয়নকাজের কারণে। লাল তীরের কার্যক্রম শুধু দেশে নয়, বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে।
কেন এ ব্যবসায়
লাল তীরের গল্পটা আমরা শুনব প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান আবদুল আওয়াল মিন্টুর কাছে। তিনি ১৯৮১ সালে ‘মাল্টিমুড ট্রান্সপোর্ট কনসালট্যান্ট’ নামে ব্যবসা শুরু করেন, যা এখনকার মাল্টিমুড গ্রুপ। এ গ্রুপের অধীন লাল তীর সীড। শুরুতে আবদুল আওয়ালের ব্যবসার ক্ষেত্র ছিল পরিবহন, টেক্সটাইল, ব্যাটারির কার্বন রড তৈরি, প্যাকেজিং ও সুতা উৎপাদন। পাশাপাশি ভোগ্যপণ্য ও খাদ্যপণ্য আমদানি ব্যবসার সঙ্গেও জড়িত ছিলেন তিনি।
তাহলে এসব ছেড়ে বীজ উৎপাদনে কেন? এর সরল জবাব আবদুল আওয়াল মিন্টুর, ‘আমি খুব বিদেশে যেতাম। দেখতাম বিদেশে কত ধরনের সবজি। এসব সবজির রং ও আকার দেখে আমার বেশ ভালো লাগত। আর দেশের সবজি দেখে মন খারাপ হতো। তখনই সবজির বীজে যুক্ত হওয়ার ইচ্ছা জাগে।’
এরপর ১৯৯৫ সালে ইস্ট ওয়েস্ট সীড বাংলাদেশ লিমিটেড নামে কার্যক্রম শুরু হয়।
তবে এর পেছনে একটা সুন্দর গল্প আছে। সেটি হলো নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও স্যার ফজলে হাসান আবেদের আমন্ত্রণে সাইমন গ্রুট নামের এক ডাচ নাগরিক এসেছিলেন ঢাকায়। পরে তিনি বিশ্ব খাদ্য সংস্থার (এফএও) সর্বোচ্চ কৃষি পুরস্কার পান। তখন তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় আবদুল আউয়াল মিন্টুর। সাইমন গ্রুট তাঁকে পরামর্শ দিলেন, মানুষের জন্য রাজনীতি করছেন ঠিক আছে, কিন্তু কৃষক বা জেলেদের মতো মানুষের জন্য কিছু করা উচিত। সাইমন গ্রুট সাহসও দিল।
সেই থেকেই বীজ নিয়ে কাজ শুরু, যা এখনো চলছে। আর তখনকার ইস্ট ওয়েস্ট সীডই এখনকার লাল তীর সীড।
লাল তীরের যত বীজ
লাল তীর এখন পর্যন্ত যেসব বীজ উৎপাদন, উন্নয়ন ও বাজারজাত করছে, সেগুলো হলো করলা, উচ্ছে, লাউ, মিষ্টিকুমড়া, ঝিঙে, চিচিঙ্গা, ধুন্দুল, চালকুমড়া, শসা, ক্ষীরা, তরমুজ, টমেটো, বেগুন, মরিচ, বাঁধাকপি, ব্রোকলি, ওলকপি, মুলা, গাজর, ঢ্যাঁড়স, পেঁয়াজ, পেঁপে, বরবটি, দেশি শিম, ফ্রেঞ্চ বিন, লেটুস, ডাঁটা, লালশাক, সবুজ শাক, পালংশাক, কলমিশাক, পুঁইশাক।
এ ছাড়া ফুলের মধ্যে গাঁদা, আঁশজাতীয় ফসলের মধ্যে তুলা, পাট ও তৈলবীজ–জাতীয় ফসলের মধ্যে শর্ষে ও সয়াবিনের বীজ উৎপাদন করছে লাল তীর। পাশাপাশি ডালজাতীয় শস্যের মধ্যে মুগ, কলাই ও মসুর ডাল উৎপাদিত হচ্ছে। এখন ধান, গম, ভুট্টা ও আলুর বীজে জোর দিয়েছে লাল তীর।
এ জন্য লাল তীরে রয়েছেন একদল বিজ্ঞানী, গবেষক ও কর্মী। সারা দেশের বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে লাল তীরের নিজস্ব মাঠ। সেখানে চলে গবেষণা ও উৎপাদন কার্যক্রম। সবজির জন্য লাল তীরের রয়েছে চারটি বীজ উৎপাদনকেন্দ্র ও গবেষণাগার। পাশাপাশি ধানের বীজের জন্য ময়মনসিংহের ভালুকায় ও গরু-মহিষের জন্য ভালুকার উথুরায় গবেষণাগার গড়ে তুলেছে লাল তীর। লাল তীর কিন্তু জাত বাজারজাত করে বসে নেই, জাত উন্নয়নে কাজ অব্যাহত রেখেছে সব সময়ই। কারণ, লাল তীর বিশ্বাস করে, নতুনত্ব ছাড়া এ ব্যবসা ধরে রাখা যাবে না। এ জন্য এখনো জোর বেশি গবেষণায়।
পাশাপাশি আফ্রিকায় কৃষি নিয়ে কাজ করছে লাল তীর এবং বীজ রপ্তানিও করছে।
আবদুল আওয়াল বলেন, এখন শীতকালীন সবজির মধ্যে কপি বাদে সবই বাংলাদেশের জাত উন্নয়ন করা। সবই উৎপাদিত হচ্ছে দেশে। বাংলাদেশে পেঁয়াজের জাত উন্নয়ন হলেও পরিবেশগত কারণে বীজ উৎপাদন করতে হয় আমেরিকায়। পরে দেশে আনা হয়।
আবদুল আওয়াল আরও বলেন, ভালো পেঁয়াজের বীজ উৎপাদন করতে দিন ও রাত সমান হতে হবে কমপক্ষে দুই সপ্তাহ। যেটা বাংলাদেশে সচরাচর পাওয়া যায় না। এ জন্য আমেরিকায় বীজ উৎপাদন করতে হয়।
বীজের ব্যবসা কত
লাল তীর ১৯৯৫ সালে বীজ ব্যবসায় যুক্ত হলেও বীজ উৎপাদন ও গবেষণায় চলে যায় কয়েক বছর। পরে ২০০১ সালে এক কোটি টাকার বীজ বিক্রি করে। ২০০৩ সালে তা বেড়ে হয় আড়াই কোটি। আর ২০২০ সালে লাল তীরের ১৭০ কোটি টাকার বীজ বিক্রি হয়। চলতি বছরে বীজের বিক্রি ২০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার আশা করছে লাল তীর। এখন দেশে সবজির বীজের বাজার প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। এর বড় অংশই লাল তীরের।
আবদুল আওয়াল জানান, লাল তীরের উদ্দেশ্য শুধু মুনাফা করা না, এর অন্যতম উদ্দেশ্য বীজের উৎপাদনশীলতা বাড়ানো ও সব সময়ে উৎপাদন উপযোগী বীজ তৈরি করা। এ ছাড়া উপকূল এলাকার উপযোগী সবজি বীজ উৎপাদনে কাজ করছে লাল তীর। এ জন্য রামপালে গবেষণাগার গড়ে তোলা হয়েছে।
এমন বীজ উৎপাদনের উদ্যোগের ফলে দেশের মানুষের কাছে সারা বছর সবজি পৌঁছে যাচ্ছে। আর শহরের ছাদ ও কৃষকের মাঠ যেন এক হয়ে উঠেছে।
সূত্রঃ প্রথম আলো।
তারিখঃ জানুয়ারী ০১, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,