লেখক:প্রতীক বর্ধন।
বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে রেহমান সোবহানের নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। যাঁদের হাত ধরে বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা, তিনি তাঁদের মধ্যে পুরোধা ব্যক্তিত্ব। বলা যায়, তাঁর লেখালেখি-তৎপরতা সব এক সূত্রে গাঁথা; যার লক্ষ্য হলো এই জাতির কল্যাণ।
রেহমান সোবহানের প্রধান কৃতিত্ব হচ্ছে, পাকিস্তান আমলে দুই অর্থনীতি সম্পর্কে জাতিকে সজাগ করা। বলা হয়ে থাকে যে পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের অর্থনৈতিক বৈষম্য সম্পর্কে প্রথম লেখেন ড. এম খালেক। পাকিস্তানের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সমালোচনা লিখেছিলেন তিনি, তাতে তিনি এই বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। অন্যান্য বিষয়ে আলোচনার সঙ্গে এই বিষয়টি তুলে ধরেন তিনি। কিন্তু সেটাই একসময় প্রধান ইস্যু হয়ে যায়। রেহমান সোবহান দুই অর্থনীতির বিষয়টি অত্যন্ত চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেন। সাধারণ ও বিজ্ঞ সমাজের মধ্যে তাঁর এই চিন্তাপ্রসূত রচনা খুবই সমাদৃত হয় ফ্রম টু ইকোনমিস টু টু নেশন—এটা তাঁর জীবনসিক্ত রচনা। এর মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে বিরাজমান বৈষম্য সম্পর্কে মানুষ সজাগ হয়।
রেহমান সোবহান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে বহির্বিশ্বে অনেক কাজ করেছেন, বক্তৃতা দিয়েছেন। রেহমান সোবহানের পরামর্শে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ সরকার পরিকল্পনা সেল গঠন করে, যা পরবর্তীকালে পরিকল্পনা কমিশনে পরিণত হয়। অর্থাৎ দেশের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার বিষয়টি যে প্রয়োজনীয়, মুক্তিযুদ্ধের সময় রেহমান সোবহান তাজউদ্দীন আহমদকে তা অবগত করেন। তাজউদ্দীন আহমদ তা স্বীকার করে পরিকল্পনা সেল গঠন করার উদ্যোগ নেন।
স্বাধীনতার পর তিনি নবগঠিত পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সরকার যে সম্পদের জাতীয়করণ করে, তার পেছনেও রেহমান সোবহানের বড় ভূমিকা ছিল। তবে এই জাতীয়করণের ব্যর্থতার জন্য তাঁর অনেক সমালোচনা হয়। এ নিয়ে রেহমান সোবহান ও মোজাফফর আহমেদ একটি বই লেখেন এবং তাঁরা দেখান, জাতীয়কৃত শিল্প–উদ্যোগগুলোর ব্যর্থতা সম্পর্কে যত কথা বলা হয়, প্রকৃত অর্থে সেগুলো অতটা ব্যর্থ হয়নি। এর অনেক সফলতাও আছে। আর এই শিল্প ব্যর্থ বলে যে ব্যক্তিমালিকানায় ছেড়ে দেওয়া হলো, তাতে দেখা যায়, শিল্প বাদ দিয়ে ভূসম্পত্তির যে মূল্য, তার চেয়েও অনেক কম মূল্যে সেসব বিক্রি করা হয়েছে। অর্থাৎ এই ব্যর্থতার গল্পের রাজনৈতিক-অর্থনীতি আছে। সে জন্য একশ্রেণির রাজনীতিবিদ ও অর্থনীতিবিদেরা সব সময় এর ব্যর্থতার গল্প প্রচার করেন। বলা বাহুল্য, রেহমান সোবহান সারা জীবন এই রাজনৈতিক-অর্থনীতির তত্ত্ব তালাশ করেছেন।
স্বাধীনতার পর দীর্ঘ সময় বাংলাদেশ বিদেশি ঋণনির্ভর ছিল। উন্নয়ন বাজেটের সিংহভাগই আসত বিদেশি ঋণ থেকে। কিন্তু এই বিদেশ–নির্ভরতা যে একটি দেশকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে দেয় না, সে বিষয়ে কলম ধরেছেন রেহমান সোবহান। তিনি বলেন, এই ঋণদাতারা দেশের নীতি প্রণয়নে অন্যায়ভাবে প্রভাব বিস্তার করে। ঋণের সঙ্গে তারা শর্ত জুড়ে দেয়। ঋণদাতাদের এসব কার্যক্রম দেশীয় অর্থনীতি বিকাশে ক্ষতিকর বলে মনে করেন তিনি। সে জন্য উদার বাণিজ্য ও বাজার উদারীকরণের পক্ষে কলম ধরেছেন তিনি। এসব বিষয়ে দেশে মতামত গঠনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন রেহমান সোবহান। সহায়তার রাজনৈতিক-অর্থনীতি নিয়ে বই লিখেছেন।
স্বাধীনতার পর রেহমান সোবহানসহ বঙ্গবন্ধুর পরামর্শক অর্থনীতিবিদেরা পরিকল্পনা কমিশনে যোগ দেন। এর পরের ইতিহাস সবারই জানা। একসময় তাঁরা পরিকল্পনা কমিশন ছাড়তে বাধ্য হন। রেহমান সোবহান বিদেশে চলে যান। সেই সময়ের অনেকেই বলেন, তাঁরা বঙ্গবন্ধুকে ত্যাগ করেছিলেন; আবার অনেকেই বলেন, বঙ্গবন্ধু কিছু ত্যাগ করেছিলেন, যার ফলে তাঁরা তাঁকে ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ইতিহাসে সেই আলোচনা চলবে।
এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হন। রেহমান সোবহান দেশে ফিরে ১৯৭৮ সালে বিআইডিএসে যোগ দেন। বিআইডিএসের গবেষণা পরিষদে ছিলেন, এরপর মহাপরিচালক হিসেবেও ছিলেন তিনি। বলা হয়, দুবারের বেশি একজনের বড় পদে থাকা উচিত নয়। অন্যদের সুযোগ দেওয়ার জন্য জায়গা ছেড়ে দেওয়া উচিত। ক্ষমতার ভারসাম্যের জন্যও তা জরুরি। দেশে এ রকম একটি নিয়ম প্রবর্তিত হয়েছিল বিআইডিএসে। সেটা হলো, মহাপরিচালক দুই মেয়াদের বেশি থাকবেন না। নিজের হাতে অধ্যাপক রেহমান সোবহান এই আইন করে বিআইডিএসে যোগ দিয়েছিলেন, পরবর্তীকালে সেটা কার্যকর করে তিনি দায়িত্ব ছাড়েন।
রেহমান সোবহান বিআইডিএসের মহাপরিচালকের দায়িত্ব ছেড়ে কিছু দিন সম্মানিত ফেলো হিসেবে কাজ করেন। এরপর তিনি সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) প্রতিষ্ঠা করেন। একসময় তিনি সিপিডির নির্বাহী সভাপতির দায়িত্ব ছেড়ে অনির্বাহী সভাপতি হন। অর্থাৎ পরবর্তী প্রজন্মের কাছে দায়িত্ব ছেড়ে দিতে তিনি কুণ্ঠিত নন।
অধ্যাপক রেহমান সোবহান সারা জীবন বৈষম্যের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি উচ্চ কণ্ঠ থেকেছেন। তাঁর কাজের অন্যতম ক্ষেত্র হচ্ছে গণতান্ত্রিক সমাজের বিকাশ ও উন্নয়নের ধারণা। সমস্যা চিহ্নিত করার পাশাপাশি এসব সমস্যা নিরাময়ের পদ্ধতি কী, তার পেছনের রাজনৈতিক অর্থনীতি কী, সেই অনুসন্ধান করেছেন তিনি। রাজনৈতিক অর্থনীতি হলো, অর্থনীতির মধ্যে বিভিন্ন গোষ্ঠী পরস্পরের সঙ্গে কী ধরনের সম্পর্ক নিয়ে বিকাশ লাভ করে বা অর্থনীতির ফলাফল নিয়ন্ত্রণ করে, তার মধ্যে বিভিন্ন গোষ্ঠী ও ব্যক্তি সমাজের কোন শ্রেণির সঙ্গে কীভাবে সম্পর্কিত হচ্ছে বা সেই সম্পর্ক কীভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে, সেই শাস্ত্র। এখন অশীতিপর বয়সেও তিনি এসব নিয়ে সোচ্চার। এ ছাড়া সমাজের সবাই যেন সমান সুযোগ পায়, সে বিষয়েও তিনি নিরন্তর কথা বলছেন।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে, রেহমান সোবহান কখনোই বাজার অর্থনীতির সমর্থক ছিলেন না। তবে বাজারের সুবিধা তিনি কাজে লাগানোর পক্ষে। মূল ধারার বামপন্থীদের থেকে তিনি ঠিক এ কারণেই ভিন্ন। আবার বাজার সব সমস্যার সমাধান করে দেবে, এটাও তিনি বিশ্বাস করেন না। তিনি একরকম নিয়ন্ত্রিত বাজারে বিশ্বাস করেন।
রেহমান সোবহানের একটি অনালোচিত দিক হলো, আঞ্চলিক সহযোগিতা নিয়ে তাঁর কর্ম-তৎপরতা। তিনি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আঞ্চলিক সহযোগিতার পরিসর দেখেছেন। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশের মতো দেশ তার সম্পদ, ভৌগোলিক অবস্থান ও সম্ভাবনা ইত্যাদির নিরিখে আঞ্চলিক নিবিড় সহযোগিতা থেকে নানাভাবে উপকৃত হতে পারে। আঞ্চলিক সহযোগিতা থেকে বাংলাদেশ উপকৃত হবে, সেই প্রতিফলন বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়ও পাওয়া যায়, রেহমান সোবহান যে কমিশনের সদস্য ছিলেন। আঞ্চলিক বাজারের সুবিধা, দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক কীভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে পারে, সে কথা প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ছিল। পাটের বাণিজ্য আঞ্চলিক সমঝোতার ভিত্তিতে করা যায় কি না, ভারতের সঙ্গে গ্যারান্টেড বাইব্যাক করা যায় কি না, বা ভারত ও দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক বাজারে আমরা কীভাবে প্রবেশ করতে পারি, কোন ধরনের শর্তে তা হতে পারে, এসব ব্যাপারে তিনি বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
তারলক সিং নামের একজন চিন্তাবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহানের চিন্তাধারা প্রভাবিত করেছেন, সে কথা তিনি লিখেছেন। ১৯৭০-এর দশকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর আঞ্চলিক সহযোগিতার মাধ্যমে কীভাবে সবার জন্য লাভজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা যায়, তা নিয়ে ভাবতে ও কাজ করতে তারলক সিং দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতিবিদদের নিয়ে একটি সংগঠন তৈরি করেন, যার অন্যতম সদস্য ছিলেন অধ্যাপক রেহমান সোবহান। ১৯৭৮ সালে রেহমান সোবহান ভিজিটিং ফেলো হিসেবে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। সেখানে আরও বিস্তৃত পরিসরে তিনি এ নিয়ে চিন্তাভাবনা করেন। আঞ্চলিক সহযোগিতা, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও যোগাযোগের মাধ্যমে আঞ্চলিক সহযোগিতা কীভাবে কার্যকর করা যায় এবং বাংলাদেশ সেখান থেকে কীভাবে লাভবান হতে পারে, সেটাই তাঁর চিন্তার মূল ক্ষেত্র। রিডিসিকভারিং দ্য সাদার্ন সিল্ক রুট বইটি তিনি সেই লক্ষ্যেই লিখেছেন। সেখানে তিনি জানান, অনেক বছর আগেই চীন থেকে ভারতবর্ষে বাণিজ্যের জন্য কাফেলা আসত। ওই বাণিজ্যপথ ধরে আবার শুধু ব্যবসা-বাণিজ্য নয়, চিন্তাভাবনারও আদান-প্রদান হতো। আরেকটি বই রেহমান সোবহান লিখেছেন ইন্টিগ্রেটিং দ্য ইস্টার্ন সাউথ এশিয়া নামে।
এই দুটি বইয়ে আমরা তাঁর চিন্তার বিষয়ে যেমন জানতে পারি, তেমনি চিন্তার বিস্তৃতি ও বিকাশ লক্ষ করি। যেমন সংযোগের একাধিক মাধ্যম পরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করে আঞ্চলিক সহযোগিতা এগিয়ে নিয়ে নিতে হবে। আর এ লক্ষ্যে শুধু সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ নয়, সমন্বিত উদ্যোগ দরকার। এটা যে করতে হবে, সেই ধারণা তিনি নিয়ে আসেন—বাণিজ্য সংযোগ, বিনিয়োগ সংযোগ, পরিবহন সংযোগ ও মানুষে-মানুষে সংযোগ। এগুলোর মধ্য দিয়ে তিনি দক্ষিণ এশীয় অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখা শুরু করেন। এই সংযোগ স্থাপন করা গেলে দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব বলে তিনি মনে করেন। সঠিক ও পরিকল্পিত উপায়ে বাস্তবায়ন করা গেলে তা সাধারণ মানুষের জন্য কল্যাণকর হবে। পরবর্তীকালে তাঁর বিভিন্ন রচনায় আমরা এই চিন্তার প্রাধান্য দেখি।
তিনি শুধু এসব নিয়ে কথাই বলেননি, কাজও করেছেন। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ রেহমান সোবহানের সহপাঠী ছিলেন। মনমোহন সিংহ যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী, তখন ভারতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানির অনুমতি লাভে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
১৯৯১ সালে দেশের প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরিকল্পনা ও অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হন রেহমান সোবহান।
রেহমান সোবহান এখন পর্যন্ত ২৭টি বই ও অসংখ্য গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করেছেন। তিনি আজীবন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায্যতার জন্য লড়াই করেছেন। তরুণ বয়সে তিনি ফ্রম টু ইকোনমি টু টু নেশন লিখে খ্যাতি পেয়েছিলেন। আর ৮০ পেরোনোর পর তাঁর উপলব্ধি, বাংলাদেশ এখন দুই সমাজে বিভক্ত—ফ্রম টুন নেশনস টু টু সোসাইটিস।
তবে রেহমান সোবহান বাংলায় লেখেন না। বাংলা বলতেও তিনি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। কিন্তু সারা জীবন তিনি জাতির কল্যাণেই কাজ করেছেন। অশীতিপর রেহমান সোবহান এখনো বুদ্ধিবৃত্তির জগতে অত্যন্ত সক্রিয়। জাতির যেকোনো ক্রান্তিলগ্নে তাঁর কণ্ঠস্বর শোনা যায়। তিনি এখনো নিয়মিত লেখালেখির পাশাপাশি সভা-সেমিনারে অংশ নেন।
রেহমান সোবহানের উল্লেখযোগ্য বইগুলো হলো: পাবলিক এন্টারপ্রাইজ ইন ইন্টারমিডিয়েট রেজিম: আ স্টাডি ইন দ্য পলিটিক্যাল ইকোনমি অব বাংলাদেশ, পাবলিক এন্টারপ্রাইজ অ্যান্ড দ্য নেচার অব দ্য স্টেট: দ্য কেইস অব সাউথ এশিয়া, ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক রিলেশনস উইদিন সাউথ এশিয়া: প্রসপেক্টস ফর রিজিওনাল কো–অপারেশন, পলিটিক্যাল ডাইমেনশনস অব সাউথ এশিয়া কো–অপারেশন: দ্য পারসপেকটিভ ফর বাংলাদেশ ইত্যাদি।
সূত্রঃ প্রথম আলো।
তারিখঃ জানুয়ারী ০১, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,