লেখক:শুভংকর কর্মকার।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সাফল্য এখন অর্থনীতিতে। ৫০ বছরে বাংলাদেশ নামের কথিত ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হয়ে উঠেছে চমকেভরা জাদুর বাক্স। সাহায্যনির্ভর বাংলাদেশ এখন বাণিজ্যনির্ভর দেশে পরিণত। তবে যাত্রাপথটা সহজ ছিল না। বড় বড় ঝুঁকি নিয়ে অভিনব পথে এগিয়ে নিয়ে গেছেন আমাদের সাহসী উদ্যোক্তারা। এই সাফল্যের পেছনে আরও যাঁরা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে অর্থনীতিবিদ যেমন ছিলেন, আছেন নীতিনির্ধারকেরাও। মূলত অর্থনীতির এসব অগ্রনায়ক, পথরচয়িতা ও স্বপ্নদ্রষ্টারাই ৫০ বছরে বিশ্বে বাংলাদেশকে বসিয়েছেন মর্যাদার আসনে।
আমরা বেছে নিয়েছি সেই নায়কদের মধ্যে ৫০ জনকে। আমাদের কাছে তাঁরাই অর্থনীতির ‘গেম চেঞ্জার’।
দেশ স্বাধীনের পর পাঁচ দশকে বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল শিল্প খাত হচ্ছে তৈরি পোশাক। বর্তমানে মোট রপ্তানির ৮০ শতাংশের বেশি এই খাতটি থেকেই আসে। তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ বিশ্বে বর্তমানে তৃতীয়। করোনার আগে অবশ্য দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ। সেই পোশাক রপ্তানিকে পথ দেখিয়েছিলেন রিয়াজ গার্মেন্টসের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ রিয়াজউদ্দিন।
১৯৭৮ সালের ২৮ জুলাই মোহাম্মদ রিয়াজউদ্দিন ১০ হাজার শার্ট ফরাসি ক্রেতা হলান্ডার ফ্রঁসের কাছে রপ্তানি করেন। শার্টের ওই চালানের ফরাসি মুদ্রায় দাম ছিল ১৩ মিলিয়ন ফ্রাঁ, বাংলাদেশি টাকায় যা ছিল ৪ লাখ ২৭ হাজার টাকা। সেটিই ছিল বাংলাদেশ থেকে প্রথম পোশাক রপ্তানি। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি টিকে না থাকলেও পোশাকশিল্পের ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে মোহাম্মদ রিয়াজউদ্দিন ও তাঁর রিয়াজ গার্মেন্টসের নাম।
মোহাম্মদ রিয়াজউদ্দিন প্রথম পোশাক রপ্তানি করলেও প্রথম শতভাগ রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানা গড়েছিলেন মোহাম্মদ নূরুল কাদের। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিষ্ঠান ‘দাইয়ু’–এর সঙ্গে যৌথভাবে চট্টগ্রামে দেশ গার্মেন্টস নামে কারখানা গড়ে তোলেন তিনি। ১৩০ জনকে দক্ষিণ কোরিয়ায় নিয়ে ছয় মাসের প্রশিক্ষণ দেন। তাঁদের অনেকেই পরে পোশাকশিল্পের বড় উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন।
আবার মোহাম্মদ রিয়াজউদ্দিনের বিষয়ে ফেরা যাক। ১৯৫৮ সালে তিনি পারিবারিক গার্মেন্টস ব্যবসায়ে যোগ দেন। করাচি থেকে কাপড় ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র এনে তাঁরা বিক্রি করতেন। বছর দুয়েক পর রিয়াজউদ্দিন ও তাঁর ভাগিনা মো. মাইজুদ্দিন মিলে চকবাজারে ‘রিয়াজ স্টোর’ চালু করেন। সেখানে শার্টসহ নারী ও পুরুষের অন্যান্য পোশাক বিক্রি হয়। পাশেই ছোট্ট কারখানায় আটটি সেলাই মেশিনে ক্রয়াদেশের পোশাক তৈরি করতেন শ্রমিকেরা। রিয়াজ স্টোরে তখন উন্নত মানের শার্ট তৈরি হতো। সেই শার্ট তৈরির জন্য মারওয়াড়ী বণিকদের কাছ থেকে জাপানি কাপড় সংগ্রহ করতেন রিয়াজউদ্দিন। কয়েক বছরের মধ্যেই দেশের বিভিন্ন জায়গায় রিয়াজ স্টোরের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। ষাটের দশকে একটি রিয়াজ শার্টের সর্বোচ্চ দাম ছিল ১০০ টাকা। সমাজের উচ্চবিত্তেরা সেই শার্ট পরতেন। চাহিদা মেটাতে কারখানার সেলাই মেশিনের সংখ্যা ২০টিতে উন্নীত করতে হয়েছিল।
সেই সময় একটি দারুণ ঘটনা ঘটে। ১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই চাঁদের বুকে পা রাখেন অ্যাপোলো-১১–এর তিন নভোচারী নীল আর্মস্ট্রং, মাইকেল কলিন্স ও এডউইন অলড্রিন। তাঁরা পৃথিবীতে ফিরে আসার পর যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন সেই বিজয়ের আনন্দ বিশ্ববাসীর সঙ্গে ভাগাভাগি করে দিতে তিন নভোচারীকে বিশ্বভ্রমণে পাঠান। ওই বছরের ২৭ অক্টোবর ঢাকা তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণ করেন তিন নভোচারী। সেদিন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে তাঁদের নাগরিক সংবর্ধনা অনুষ্ঠান ছিল। শত শত মানুষের মধ্যে রিয়াজউদ্দিন সেই অনুষ্ঠানে নিজের রিয়াজ স্টোরের তিনটি শার্ট নভোচারীদের উপহার দেন। নভোচারীরা সেই শার্ট উপহার হিসেবে গ্রহণ করেন। তাঁদের কাছ থেকে ধন্যবাদ ও প্রশংসাসূচক একটি চিঠিও পান রিয়াজউদ্দিন।
রিয়াজউদ্দিন শার্ট রপ্তানির উপায় খুঁজছিলেন। সে জন্য বেশ কয়েকবার করাচি ঘুরে এলেন। তবে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের কারণে সেই পরিকল্পনায় ছেদ পড়ে। তখন চকবাজারের অন্য সব দোকানপাটের সঙ্গে রিয়াজউদ্দিনের রিয়াজ স্টোর ও কারখানা পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পুড়িয়ে দেয়। দেশ স্বাধীনের পর নতুন করে শুরু করলেন রিয়াজউদ্দিন। চকবাজারের পাশেই উর্দু রোডে কারখানা দিলেন। ১৯৭৩ সালে সেই প্রতিষ্ঠানের নাম দেন রিয়াজ গার্মেন্টস লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন মোহাম্মদ রিয়াজউদ্দিন। পরিচালক ছিলেন মো. মাইজুদ্দিন।
রিয়াজ শার্টকে জনপ্রিয় করতে নানামুখী উদ্যোগ নেন রিয়াজউদ্দিন। নিজের প্রতিষ্ঠানের ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ স্লোগান ছড়িয়ে দিতে একটি বাইসাইকেল রেসে অর্থায়ন করলেন। কলকাতার মোহনবাগান ক্লাবের খেলোয়াড়েরা যখন বাংলাদেশে আসেন, তাঁদের শার্ট উপহার দিলেন। মোহনবাগানের তখনকার জনপ্রিয় খেলোয়াড় চুনি গোস্বামির ছবি দিয়ে তৈরি করা বিজ্ঞাপনও পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। সেই বিজ্ঞাপনে চুনি গোস্বামির বরাত দিয়ে লেখা ছিল, ‘বাংলাদেশে খেলতে এসে আমরা খুব খুশি হয়েছি রিয়াজ গার্মেন্টসের শার্ট পরতে পেরে…।’
১৯৭৬ সালে বাংলাদেশের প্রথম কৃষি ও শিল্প মেলায় রিয়াজ গার্মেন্টসের একটি প্যাভিলিয়ন দেন রিয়াজউদ্দিন। পরের বছর ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) কর্মকর্তাদের রিয়াজ শার্ট রপ্তানি করার বিষয়ে রাজি করানোর চেষ্টা করেন রিয়াজউদ্দিন। বেশির ভাগ কর্মকর্তাই নিরাশ করলেন। তবে আশার আলো দেখালেন বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিব। তাঁর চেষ্টায় রিয়াজ গার্মেন্টসের শার্টের নমুনা ফ্রান্সে পাঠানো হলো। সেই শার্টের মান দেখেই ক্রয়াদেশ আসে। ১৯৭৮ সালে ১০ হাজার শার্ট ফরাসি ক্রেতা হলান্ডার ফ্রঁসের কাছে রপ্তানি করেন রিয়াজউদ্দিন। পরের দুই বছর আরও ২ লাখ ৮০ হাজার শার্ট রপ্তানির তিনটি ক্রয়াদেশ পায় তাঁর প্রতিষ্ঠান।
পুরান ঢাকায় ১৯৩৪ সালের ৩ অক্টোবর রিয়াজউদ্দিনের জন্ম। স্ত্রী মমতাজ বেগম, দুই মেয়ে ফাতেমা বেগম ও মরিয়ম ইসলাম এবং চার ছেলে মো. গিয়াসউদ্দিন, মো. আযাজউদ্দিন, মো. নিয়াজউদ্দিন ও মো. সালাউদ্দিনকে নিয়ে মোহাম্মদ রিয়াজউদ্দিনের সংসার ছিল। পোশাক কারখানায় নারী শ্রমিকদের কাজ করার পরিকল্পনাটিও রিয়াজউদ্দিনই প্রথম করেছিলেন। শুরুতে সফল হলেন না, কারণ কারখানায় কাজ করলে পরিবারের সুনাম নষ্ট হতে পারে এই ভয়ে কেউ আসছিল না। তখন ১৯৭৭ সাল। নিজেই উপায় বের করলেন। নিজের বড় মেয়ে ফাতেমা বেগমকে বুঝিয়ে–শুনিয়ে মাসিক ১০০ টাকা বেতনে কারখানায় নিয়োগ দিলেন। তাঁকে দেখে আশপাশের নারীরা আগ্রহ দেখালেন। প্রথম দিকে ৫ জন নারীশ্রমিক রিয়াজ গার্মেন্টসে যোগ দেন।
১৯৯৮ সালে গাজীপুরের বোর্ডবাজারে নতুন কারখানা করলেন রিয়াজউদ্দিন। সেই কারখানার নাম রিয়াজ এক্সপোর্ট অ্যাপারেল। সেখানে দিনে পাঁচ হাজার শার্ট তৈরি হতো। আর উর্দু রোডের কারখানায় দিনে তৈরি হতো ৩ হাজার শার্ট। কারখানা দুটিতে তখন কাজ করতেন ৭৫০-৮০০ পোশাকশ্রমিক। তবে সাড়ে ৫ কোটি টাকা ব্যাংকঋণে বোর্ডবাজারের কারখানাটি করার বছর তিনেক পর থেকেই নানামুখী সমস্যা শুরু হয়। ২০০৩ সালে ইতালির এক ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের ৮-৯ লাখ ডলারের শার্টের ক্রয়াদেশ পায় রিয়াজ গার্মেন্টস। ৩-৪ লাখ ডলারের শার্ট ঠিকঠাক রপ্তানিও হয়। তারপর হঠাৎ ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানটি দেউলিয়া হলে বাকি শার্ট স্টক লটে বিক্রি করতে হয়। তখন ঋণের বোঝা আরও বেড়ে যায়। তারপর আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি রিয়াজ গার্মেন্টস।
২০০৫ সালের ৫ এপ্রিল রিয়াজউদ্দিন মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পর রিয়াজ গার্মেন্টস ও রিয়াজ এক্সপোর্ট অ্যাপারেল তিন বছর টিকে ছিল। মোহাম্মদ রিয়াজউদ্দিনের ব্যবসায় তাঁর বড় ছেলে মো. গিয়াসউদ্দিন ১৯৮৩ সালে যোগ দেন। ১৯৯০ সালে আযাজউদ্দিন এবং ১৯৯৪ সালে নিয়াজউদ্দিন ও সালাউদ্দিন যোগ দেন। ২০১২ সালে আযাজউদ্দিন মারা যান। অন্য দুই ভাইও বর্তমানে পোশাকের ব্যবসায় নেই। ছোট ছেলে মো. সালাউদ্দিন বর্তমানে বায়িং হাউসের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত আছেন।
মোহাম্মদ রিয়াজউদ্দিন সম্পর্কে জানতে তাঁর ছেলে মো. সালাউদ্দিনের সঙ্গে গত মঙ্গলবার রাতে কথা হয়। বাংলাদেশের প্রথম পোশাক রপ্তানিকারক সম্পর্কে জানতে চাই বলার পরপরই আন্তরিকতার সঙ্গে স্মৃতির ঝাঁপি খুলে দিলেন। অল্প সময়ের মধ্যেই মোহাম্মদ রিয়াজউদ্দিন ও তাঁর রিয়াজ গার্মেন্টসের বিভিন্ন তথ্যউপাত্ত ও কয়েক দশকের পুরোনো স্থিরচিত্র দিলেন। নিজের বাবা সম্পর্কে মো. সালাউদ্দিন বলেন, ‘আমার বাবা একজন সহজ-সরল মানুষ ছিলেন। তাঁর অনেক স্বপ্ন ছিল। তবে ব্যাংকের ঋণ কিংবা দায়দেনাকে ভীষণভাবে ভয় পেতেন। সে জন্য সুযোগ থাকার পরও ব্যবসা বড় করেননি।’ তিনি বলেন, ‘বাবা মারা যাওয়ার পর ঋণের বোঝা নিয়ে কারখানা চালাতে সায় দিলেন না আমার মা। তাঁর ইচ্ছেমতোই আমরা সবকিছু বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করলাম।’
সালাউদ্দিন বলেন, ‘বাবার প্রতিষ্ঠানে আমি ১৯৯৪ সাল থেকে কাজ করেছি। ঐতিহাসিক সেই প্রতিষ্ঠান আর নেই। তবে সব স্মৃতি আমরা আগলে রেখেছি। রপ্তানির অনুমতিপত্র থেকে শুরু করে বন্ড লাইসেন্স সবই আছে আমাদের কাছে।’ আরও বলেন, ‘আমার বাবা ও রিয়াজ গার্মেন্টসকে নিয়ে আমাদের গর্বের শেষ নেই। দেশের ইতিহাসের সঙ্গে নামগুলো জড়িয়ে আছে। বাবাকে যেন দেশের মানুষ সব সময় শ্রদ্ধার সঙ্গে সম্মান করেন, সে জন্য আমরা রিয়াজ গার্মেন্টস নামে আর কোনো পোশাক কারখানা করতে চাই না।’
সূত্রঃ প্রথম আলো।
তারিখঃ নভেম্বর ১০, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,