লেখক: শওকত হোসেন।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সাফল্য এখন অর্থনীতিতে। ৫০ বছরে বাংলাদেশ নামের কথিত ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হয়ে উঠেছে চমকেভরা জাদুর বাক্স। সাহায্যনির্ভর বাংলাদেশ এখন বাণিজ্যনির্ভর দেশে পরিণত। তবে যাত্রাপথটা সহজ ছিল না। বড় বড় ঝুঁকি নিয়ে অভিনব পথে এগিয়ে নিয়ে গেছেন আমাদের সাহসী উদ্যোক্তারা। এই সাফল্যের পেছনে আরও যাঁরা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে অর্থনীতিবিদ যেমন ছিলেন, আছেন নীতিনির্ধারকেরাও। মূলত অর্থনীতির এসব অগ্রনায়ক, পথরচয়িতা ও স্বপ্নদ্রষ্টারাই ৫০ বছরে বিশ্বে বাংলাদেশকে বসিয়েছেন মর্যাদার আসনে।
আমরা বেছে নিয়েছি সেই নায়কদের মধ্যে ৫০ জনকে। আমাদের কাছে তাঁরাই অর্থনীতির ‘গেম চেঞ্জার’।
তিনি সেই অর্থে একজন শাস্ত্রীয় অর্থনীতিবিদ নন। অর্থনীতির নতুন কোনো তত্ত্ব তাঁর লেখা থেকে আসেনি। তিনি উদ্যোক্তাও নন। কোনো শিল্পকারখানা গড়েননি। একজীবনে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একজন ছিলেন। তবে তাঁর দেওয়া বিভিন্ন প্রস্তাব বাস্তবায়ন করার মতো রাজনৈতিক অঙ্গীকার সরকার দেখাতে পারেনি। তিনি মূলত ব্যাংকার। আজীবন একাধিক ব্যাংকে চাকরি করেছেন। আর করতেন লেখালেখি, অর্থনীতির নানা বিষয় নিয়ে। তবে তাঁর বড় পরিচয় হচ্ছে, তিনি অসম সাহস নিয়ে সত্য কথা বলতে পারতেন।
সত্যিকার অর্থেই দেশের আর্থিক খাতের বিবেক ছিলেন তিনি, ছিলেন আর্থিক খাতের বাতিঘর। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই পরিচয় তিনি সযত্নে চর্চা করেছেন। যেকোনো কঠিন পরিস্থিতিতে সত্যকণ্ঠ থেকে কখনো দূরে থাকেননি, কৌশল করে এড়িয়েও যেতেন না। খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ একজন ব্যাংকার হিসেবে, একজন বিশ্লেষক হিসেবে অর্থনীতিতে এমনিতেই জায়গা করে নিয়েছেন। তবে অসামান্য সাহসের সঙ্গে সর্বদা সত্য কথা বলার জন্যই তাঁর খ্যাতি। খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ মানেই একজন সৎ ও সাহসী মানুষের প্রতিকৃতি—এটাই মানুষ সব সময় মনে রাখবে। তিনি কথা বলতেন বলেই, দেশের আর্থিক খাতের ভালো ও মন্দ—দুটোই সাধারণ মানুষ জানতে পারত, শোধরানোর সুযোগ ছিল নীতিনির্ধারকদেরও।
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ ১৯৪১ সালে গোপালগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। খোন্দকার বংশ নিয়ে তিনি একটি বই সম্পাদনা করেছিলেন। ‘শেকড় থেকে লতাপাতা: সাতৈর-গোপীনাথপুর-গোপালগঞ্জ খোন্দকার বংশের বংশ-লতিকা’ শিরোনামের বইটিতে রয়েছে দেড় হাজার বছরে বংশের পূর্বসূরিরা কে কোথায় ছিলেন তার বিবরণী। এ–জাতীয় বংশ–লতিকার বই বিরল।
স্মৃতিকথায় তিনি
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূগোলে স্নাতকোত্তর ও আইবিএ থেকে এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করে ১৯৬৩ সালে ব্যাংকিং পেশায় যুক্ত হন। ওই বছর তিনি তৎকালীন হাবিব ব্যাংক লিমিটেডে প্রবেশনারি কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দিয়ে ব্যাংকিং জীবন শুরু করেছিলেন। তিনি তাঁর স্মৃতিকথায় এ নিয়ে লিখেছেন, ‘১৯৬৩ সনে দেশব্যাপী প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দিয়ে তৎকালীন পাকিস্তানের হাবিব ব্যাংকে যোগদান করি। আমানত, ঋণ ও সম্পদের বিচারে এটিই ছিল পাকিস্তানের সর্ববৃহৎ ব্যাংক। উদ্ভাবনী প্রবণতা ও নতুন নতুন সেবা উপহার দিয়ে চলেছিল এই ব্যাংকটি। ১৯৬৫ সনে ঢাকার মতিঝিল কার্যালয়ে তারা মেইন ফ্রেম আইবিএম কম্পিউটার স্থাপন করেছিল এবং এক ব্যাপক কার্যক্রম কম্পিউটারের আওতায় নিয়ে এসেছিল। বিভিন্ন বড় শহরে ড্রাইভ-ইন শাখা স্থাপন করেছিল—ঐসব শাখায় গাড়িতে বসে শুধু কাচ নামিয়ে বিশেষভাবে নির্মিত কাউন্টারে চেক দিলেই নগদ টাকা পাওয়া যেত। কম্পিউটার নেটওয়ার্কিং না করেও সারা দেশের ৬০টি বড় শাখার বিশিষ্ট গ্রাহকদের এক শাখার চেক অন্য শাখায় নগদায়নের ব্যবস্থা করেছিল। অভ্যন্তরীণ ট্রাভেলার চেক, গিফট চেক প্রচলন করেছিল। এ সবই ঘটেছিল সুদীর্ঘকাল পূর্বে—ষাটের দশকে।’
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ আরও লিখেছেন, ‘আজকের হাবিব ব্যাংক পাকিস্তানের বৃহত্তম রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক—ভিন্ন আঙ্গিকের, ভিন্ন চরিত্রের। এর পূর্বসূরি অর্থাৎ আমাদের হাবিব ব্যাংক ছিল ব্যক্তিমালিকানাধীন। ১৯৪১ সনে ভারতের বোম্বেতে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। মালিকরা ছিলেন বনেদি ব্যবসায়ী। বাইশ পরিবারের এক পরিবার, যারা চোদ্দপুরুষের ব্যবসায়ী। পাকিস্তানে যখন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক নষ্টচক্রে হাবুডুবু খাচ্ছে, তখন এই মালিকগোষ্ঠী পাকিস্তানে ব্যবসা হারিয়ে লন্ডনসহ বিশ্বের বিভিন্ন অংশে সফলভাবে নিজস্ব ব্যাংক—এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। এই প্রেক্ষিতটা মনে রাখতে হবে। পাকিস্তানে ব্যাংকের মালিকানা ছিল পরিবারভিত্তিক। হাবিব ব্যাংকের মালিক ছিলেন হাবিব পরিবার। পরিচালনা পরিষদের পরিচালকরা ছিলেন মূলত হাবিব পরিবারের সদস্য। পরিবারের কোনো কোনো সদস্য আবার ব্যাংকের চাকরিতেও যোগ দিয়েছিলেন, তবে অনুগ্রহ নিয়ে নয়। তাঁরা ছিলেন উচ্চশিক্ষিত—বেশির ভাগই বিলেতে লেখাপড়া শিখেছেন। পরিচালকরা সবাই ব্যবসা করতেন—কিন্তু কেউ কোনো দিন খেলাপি ছিলেন না। ব্যাংকিং কোম্পানি আইনে খেলাপি পরিচালক অপসারণের কোনো বিধানও ছিল না। আমরা হাবিব পরিবারের লোকজনদেরকে ডাকতাম শেঠজি বলে। একবার এক উচ্চপদস্থ শেঠজি করাচি থেকে ঢাকা এলেন পরিদর্শন উপলক্ষে। সন্ধ্যার পর তিনি একাকী গাড়ি নিয়ে চলে এলেন ব্যাংকের সদরঘাট শাখায়। ছুটির দিন ছিল। পাঠান দারোয়ান কলাপসিবল গেট লাগিয়ে ঘরের ভিতর বসে আছে। শেঠজি গিয়ে দারোয়ানকে দরজা খুলতে বললেন। দারোয়ানের সাফ জবাব, “ব্যাংক বন্দ হ্যায়। খুলনে কা হুকুম নেহি হ্যায়।” শেঠজি নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, তিনি করাচি হেড অফিস থেকে পরিদর্শনে এসেছেন। দারোয়ানের জবাব, “হাম শেঠজি কো পাহচানতে নেহি। ইয়ে ব্যাংক ম্যানেজার সাহাব কো হুকুম সে চলতা হায়। ম্যানেজার কা পাছ যাও।” অগত্যা শেঠজি ফিরে গেলেন এবং পরদিন ঐ দারোয়ানের জন্য একটি প্রশংসাপত্রসহ নগদ পাঁচশত টাকা পুরস্কার ঘোষণা করলেন। আমাদের দেশের হাল আমলের এক ব্যাংক মালিককে ঘটনাটি শুনিয়ে জানতে চেয়েছিলাম, তিনি হলে কী করতেন? পরিচালক কোনো চিন্তা না করেই সততার সাথে জবাব দিলেন, “…রের বাচ্চার চাকরি তো খেতামই—ম্যানেজারকেও শায়েস্তা করতাম। আমি আবার বেয়াদবি একদম সহ্য করতে পারি না”।’
কিছু উদাহরণ
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ ২০০৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যাংকিং জীবন শেষ করেন। তবে শেষ দিন পর্যন্ত দেশের আর্থিক খাতের সবচেয়ে বড় পর্যবেক্ষক ছিলেন তিনিই। দেশের ব্যাংকিং ইতিহাসের প্রায় প্রতিটি ঘটনার সাক্ষী ছিলেন, অনেক প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে তাঁকে, এরশাদ আমলে শিকার হয়েছেন হয়রানির। কিন্তু সত্য কথা বলা থেকে কখনো পিছপা হননি।
একটি ঘটনার কথা বলা যায়। ১৯৯৪ সালের দিকের কথা। তখন তিনি কৃষি ব্যাংকের এমডি। আর রাষ্ট্রমালিকানাধীন অগ্রণী ব্যাংকের এমডি মোস্তফা আমিনুর রশীদ। তৎকালীন বিএনপি সরকারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে অনিয়ম ও ঋণের অর্থ আত্মসাতের একের পর অভিযোগ আসছিল মোস্তফা আমিনুর রশীদের নামে। বাংলাদেশ ব্যাংক একটি বিশেষ পরিদর্শন প্রতিবেদন তৈরি করলেও রাজনৈতিক চাপে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছিল না; কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নিয়ে বরং অগ্রণী ব্যাংকের এমডির স্বাভাবিক অবসরে যাওয়ার সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেয়। এ নিয়ে দৈনিক সংবাদে একাধিক প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল। এর মধ্যেই অবসরে চলে যান মোস্তফা আমিনুর রশীদ, আর কৃষি ব্যাংক থেকে অগ্রণী ব্যাংকে আসেন খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। এসেই তিনি শক্ত হাতে অগ্রণী ব্যাংকের হাল ধরেন। আগের এমডি প্রায় ধ্বংসের পথে নিয়ে গিয়েছিলেন, সেখান থেকে ব্যাংকটিকে আবার ভালো অবস্থানে নিয়ে আসেন।
অগ্রণী ব্যাংকের পর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ এমডি হয়ে যান সোনালী ব্যাংকে। সে সময় ফজলুর রহমান নামের নারায়ণগঞ্জের একজন আলোচিত ঋণখেলাপি ব্যবসায়ী ছিলেন। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে যেমন ফেরত দিতেন না, তেমনি সেই অর্থ দুহাতে বিলাতেনও। ঘুষ দিয়ে কাজ আদায়ে তাঁর বিশেষ দক্ষতা ছিল। তাঁর দেওয়া উপহার পেয়েছেন—এমন মানুষের তালিকা বেশ লম্বা। সোনালী ব্যাংকে যোগ দিতেই প্রথা মেনে সেই ফজলুর রহমান বেশ কিছু উপহার পাঠান খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের কাছে। ব্যাংকের একজন এমডি কত টাকার উপহার নিত পারেন, সেই লিখিত বিধি সংযুক্ত করে সব উপহার ফেরত পাঠিয়েছিলেন তিনি। আর এর একটি অনুলিপি রেখে দিয়েছিলেন ফজলুর রহমানের ঋণের ফাইলে।
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর হিসেবে নিয়োগ পান ১৯৯৭ সালে। সে সময় গভর্নর ছিলেন লুৎফর রহমান সরকার। ১৯৯৮ সালে গভর্নর পদে যোগ দিয়েছিলেন মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন। সম্ভবত এ দুজনেই ছিলেন বাংলাদেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সেরা জুটি। ব্যাংক খাতের অনেক অনিয়ম ঠেকিয়ে দিয়েছিলেন তাঁরা। তখন অর্থমন্ত্রী ছিলেন প্রয়াত শাহ এ এম এস কিবরিয়া। অর্থমন্ত্রীর সামনেই এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন ‘দেশের ব্যাংক খাত এখন মাফিয়াদের দখলে।’ একজন ডেপুটি গভর্নরের সেই বক্তব্য যথেষ্ট আলোচিত হয়েছিল। অনেকেই তাঁর বিপদের আশঙ্কা করেছিলেন। কিন্তু সত্য প্রকাশে ছিলেন অবিচল। তৎকালীন অর্থমন্ত্রীর সমর্থন থাকায় স্বাধীনভাবে কাজ করে গিয়েছেন তিনি।
নব্বইয়ের দশকে ব্যাংক খাতে রাজনৈতিক মদদপুষ্ট শ্রমিক ইউনিয়নের দৌরাত্ম্য ছিল প্রবল। ১৯৯৭ সালে এ নিয়ে সরকার একটি টাস্কফোর্স গঠন করলে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ এর প্রধান হন। ১৯৯৮ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি চূড়ান্ত প্রতিবেদন পেশ করেছিলেন তিনি। সেই প্রতিবেদনও ছিল যথেষ্ট সাহসী। সেখানে ব্যাংক খাতে শ্রমিক ইউনিয়ন নিষিদ্ধের সুপারিশ ছিল। যদিও রাজনৈতিক কারণে তৎকালীন সরকার সুপারিশ বাস্তবায়ন করেনি।
আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পরে ২০১০ সালে ঘটে শেয়ারবাজার নিয়ে দ্বিতীয় কেলেঙ্কারি। এ সময় খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল সরকার। নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই বিস্তারিত একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছিলেন। প্রতিবেদনে সরকার ঘনিষ্ঠ অত্যন্ত প্রভাবশালী দুই ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে তাঁদের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বলেছিলেন তিনি। এরপরই কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের রোষানলে পড়েন তিনি। সরকার থেকে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় তাঁর প্রতি ব্যক্তিগত আক্রমণ, চরিত্র হননেরও অনেক চেষ্টা করা হয়। কিন্তু অবিচল ছিলেন তিনি।
২০০০ সালে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ যখন পূবালী ব্যাংকে যোগ দেন, তখন এটি ছিল দেশের দুর্বল ব্যাংকের একটি। ছয় বছর তিনি এই ব্যাংকের এমডি ছিলেন। এখন যে পূবালী ব্যাংক দেশের বেসরকারি খাতের অন্যতম সেরা ব্যাংক, এর কৃতিত্ব খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের। এই ব্যাংকে যোগ দেওয়ার দিন থেকেই নিজের কক্ষে বঙ্গবন্ধুর একটি বড় ছবি স্থাপন করেছিলেন। ২০০১ সালে বিএনপি সরকার এলেও সেই ছবি তিনি সরাননি। শেষ দিন পর্যন্ত ছবিটি ছিল। বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ অনুসারী ছিলেন তিনি।
তারপরও গত এক দশকে ব্যাংক খাতের বিশৃঙ্খলা, সুশাসনের অভাব, ঋণখেলাপিদের প্রতি আনুকূল্য প্রদর্শন ও সামগ্রিক নাজুক অবস্থার চরম সমালোচক ছিলেন তিনি। তিনি বারবার মনে করিয়ে দিতেন যে একটি ব্যাংকের ৯০ শতাংশ মালিকানা মূলত আমানতকারীদের, বাকি ১০ শতাংশের মালিকানা উদ্যোক্তাদের। সুতরাং ব্যাংক পরিচালিত হবে আমানতকারীর স্বার্থে আর তা দেখভাল করার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। এর চরম ব্যত্যয় হচ্ছে বলে তিনি এর চরম সমালোচনা করতেন, গঠনমূলক অনেক পরামর্শও দিয়েছেন।
সাহসী সত্যকথন
সব মিলিয়ে সত্য প্রকাশে তাঁর কোনো দ্বিধা ছিল না। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অভাব বা ব্যক্তিগত নিরাপত্তার স্বার্থে, অথবা প্রভাবশালীদের রোষানলে পড়ার ভয়ে অনেকই প্রকাশ্যে কথা বলতে চাইতেন না। কিন্তু আর্থিক খাত নিয়ে সত্য ও সঠিক কথা বলার ক্ষেত্রে কখনোই তিনি পিছু হটেননি। খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ সত্যিকারের একজন গণমাধ্যমবান্ধব মানুষ ছিলেন। আরও অনেকের মতো অবসর নেওয়ার পরে তিনি এই পরিচয়ে পরিচিত হননি। তিনি যখন বড় দায়িত্বে ছিলেন, তখনো ব্যাংক খাতের অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্য না লুকিয়ে বরং প্রচার পাওয়াকেই সঠিক মনে করতেন। ঋণখেলাপিদের দৌরাত্ম্য নিয়ে সারাটা জীবন সোচ্চার ছিলেন।
গত ২৭ জুন প্রথম আলোর প্রথম পাতায় প্রকাশিত খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের লেখা একটি বিশ্লেষণের শিরোনাম ছিল, ‘ব্যাংকে আগেও মাফিয়া ছিল, এখন বেড়েছে’। সেখানে তিনি অকপটে সাম্প্রতিক সময়ে নেওয়া বেশ কিছু সরকারি সিদ্ধান্তের কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। দেশের বাইরে সিকদার গ্রুপের বিপুল সম্পদ নিয়ে প্রথম আলোয় একটি বিশেষ প্রতিবেদন ছাপা হলো গত ৯ জুন। সেখানে বক্তব্য দিয়েছিলেন খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ।
পরদিন প্রভাবশালী এই গ্রুপের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ করে বলা হলো, ‘ইব্রাহিম খালেদ দেশের প্রথিতযশা ব্যাংকার, তিনি সিকদার গ্রুপের তথা সিকদার পরিবারের পটভূমি না জেনেই বিদেশে কীভাবে টাকা গেল, সে বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন, যা কেবলই দুঃখজনক। পরবর্তী সময়ে এর পরিপ্রেক্ষিতে ইব্রাহিম খালেদ তাঁর মামা সুলাইমান খান মজলিসের কাছে ফোনের মাধ্যমে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য দেওয়ার কারণে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন।’ এরও প্রতিবাদ করে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘সুলাইমান খান মজলিস সাহেব নামে আমার কোনো মামা নেই। উনি একটি ব্যাংকের এমডি ছিলেন। তাঁর সঙ্গে কথা হয়েছে। আর মাফ চাওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। আমার বক্তব্যের প্রতিটি শব্দ সত্য। এখনো সেই মন্তব্যে অটল আছি। আমার মনে হয়, সিকদার গ্রুপ আমাকে ব্ল্যাকমেল করতে চাইছে।’
অত্যন্ত সাহসী এই মানুষ প্রতিদিন নিয়ম করে সেগুনবাগিচায় কেন্দ্রীয় কচিকাঁচার মেলার কার্যালয়ে যেতেন। তিনি এর পরিচালক ছিলেন। দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সঠিক পথে রাখতে তিনি শিশু-কিশোরদের সংগঠিত করাকে গুরুত্ব দিতেন। আর্থিক খাতসহ সুশাসনের অনেক বিষয় নিয়ে তিনি হতাশ থাকলেও দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী ছিলেন।
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, ১৯৯৬ সালে অগ্রণী ব্যাংক এবং ১৯৯৭ সালে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপরে ১৯৯৮ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর ছিলেন। ২০০০ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত তিনি পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন। পরে তিনি কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত হয়ে তিনি ২০২০ সালের ৯ ডিসেম্বর মারা যান।
সূত্রঃ প্রথম আলো।
তারিখঃ নভেম্বর ২১, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,