ভূমি পূজার মধ্য দিয়ে অযোধ্যায় রাম মন্দির প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বুধবার বলেন, ‘এতগুলো বছর ভগবান রাম তাঁবুর নিচে বসবাস করছিলেন। এবার তাঁর স্থান হবে ভব্য মন্দিরে।’ তিনি বলেন, ‘বৈচিত্র্যময় ভারতকে এক সূত্রে গেঁথেছেন রামচন্দ্র। বিবিধের মাঝে তিনিই মিলনের প্রতীক। দেশের মতো বিদেশেও আজ তাই রামের নামে জয়ধ্বনি শোনা যায়।’
প্রায় ৫০০ বছরের প্রতীক্ষা শেষ হয় বুধবার। সেই সঙ্গে শেষ হয় ১৩০ বছরেরও বেশি দীর্ঘ আইনি লড়াই। বুধবার দিল্লি থেকে লক্ষ্ণৌ হয়ে তিন ঘণ্টার জন্য অযোধ্যায় এসে পূজার্চনার পর প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এই মন্দির প্রতিষ্ঠার জন্য বহু মানুষ প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। তাঁদের বলিদান আজ সার্থকতার রূপ নিতে চলেছে। আজকের দিনটি ত্যাগ, সংঘর্ষ ও সংকল্পের প্রতীক হয়ে থাকবে।’ তিনি বলেন, ‘সারা দেশ আজ রামময়। সর্বত্র রামনাম ধ্বনি। এই মন্দির হবে ভারতীয় সংস্কৃতির আধুনিকতম প্রতীক। রাষ্ট্রীয় ভাবনার প্রতিফলন ঘটবে এর মধ্য দিয়ে। সারা পৃথিবীর মানুষ আসবেন এই মিলনস্থলে। এই মন্দিরের মাধ্যমে অতীতের সঙ্গে বর্তমান ও ভবিষ্যতের মেলবন্ধন ঘটবে।’
কড়া নিরাপত্তা ও করোনাজনিত যাবতীয় বিধিনিষেধ মেনে ভূমি পূজার আয়োজন করা হয়েছিল। গোটা অযোধ্যা সেজেছিল লাল ও গেরুয়ার মিশ্রণে। কলকাতা থেকে পাঠানো হয়েছিল গাঁদা ফুল। দিল্লি থেকে লাল গোলাপ। হলুদ-লাল গাঁদায় সেজেছিল অযোধ্যার প্রতিটি মন্দির, ধর্মশালা ও সাধুদের আখড়া। প্রধানমন্ত্রীর পরনেও ছিল তারই ছোঁয়া। হলুদ কুর্তা, হলুদ-লাল অঙ্গবস্ত্র ও সাদা ধুতিতে মোড়া প্রধানমন্ত্রীর মুখ ঢাকা ছিল সাদা মুখোশে। তাঁর অযোধ্যা পরিক্রমা শুরু হয় হনুমানগড়ি মন্দির থেকে। দুর্গের আকারে তৈরি এই মন্দিরে মাথা ঠেকানোর পর রামলালার (শিশু রাম) দর্শন করাই রীতি। মোদি সেই রীতি মেনে চলে যান রামলালার অস্থায়ী ছাউনিতে। সাষ্টাঙ্গ প্রণাম ও আরতির পর তিনি যান ভূমি পূজার জায়গায়। সঙ্গী উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথ। রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের প্রধান মোহন ভাগবত ও উত্তর প্রদেশের রাজ্যপাল আনন্দিবেন প্যাটেলও তত ক্ষণে সেখানে উপস্থিত। শুরু হয় ভূমি পূজা।
রাম মন্দিরের প্রথম শিলান্যাস ১৯৮৯ সালে। কেন্দ্র ও রাজ্যে তখন কংগ্রেসের শাসন। সেই বছরের ৯ নভেম্বর প্রস্তাবিত গর্ভগৃহের বাইরে আদালতের রায়ে ‘অবিতর্কিত’ এলাকায় রাম মন্দিরের শিলান্যাস করে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ। এই কারণে বুধবার দ্বিতীয়বার শিলান্যাসপর্বের প্রয়োজন হয়নি। তবে ভূমি পূজার পর রুপার ইট ও তাম্র ফলক দিয়ে প্রধানমন্ত্রী সূত্রপাত ঘটান মূল মন্দিরের নির্মাণকাজ। সংক্ষিপ্ত সেই অনুষ্ঠান শেষে তিনি যান অপেক্ষমাণ অতিথিদের সমাবেশে। ভাষণ দেন সেখানেই। বলেন, ‘রামের চরিত্র সত্য নির্ভর। সত্য ছাড়া অসত্যের ছোঁয়া সেখানে নেই। আমাদের ধর্মও সত্যপালন। রামই সব কাজে আমাদের প্রেরণা।’
মুঘল সম্রাট বাবরের সেনাপতি মীর বাঁকি ১৫২৮ সালে অযোধ্যায় মসজিদ তৈরি করেন, যা পরবর্তীতে বাবরি মসজিদ নামে পরিচিতি লাভ করে। রাম জন্মভূমিতে ‘রামের মন্দির ভেঙে’ মসজিদ তৈরির বিতর্কের সেই শুরু। দাবি ও পাল্টা দাবি নিয়ে রেষারেষিরও শুরু তখন থেকেই। ১৯৪৯ সালের ডিসেম্বরে বিতর্কিত কাঠামোয় রামলালার মূর্তি দেখা যায়। স্থানীয় ধর্মপ্রাণ হিন্দুদের দাবি, রামলালা আবির্ভূত হয়েছেন। শুরু হয় রামলালার পূজা করার দাবি এবং তা নিয়ে আদালতের লড়াই। ১৯৮৬ সালে ফৈজাবাদ জেলা আদালতের নির্দেশে খুলে দেওয়া হয় রামলালার অস্থায়ী মন্দিরের তালা। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর করসেবকদের হামলায় ধূলিসাৎ হয় বাবরি মসজিদ। ২০১৯ সালের নভেম্বরে টানা শুনানি শেষে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈয়ের নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ সর্বসম্মতিতে বিতর্কিত জমির মালিকানার রায় মন্দিরের পক্ষে দেন। অবসরের পর রঞ্জন গগৈকে রাজ্যসভার সদস্য করা হয়।
রাম মন্দিরের ভূমি পূজার দিন উপেক্ষিত রইলেন রাম জন্মভূমি আন্দোলনের জনক বিজেপির নবতিপর নেতা লালকৃষ্ণ আদভানি। তাঁর আন্দোলনে ভর দিয়েই লোকসভায় বিজেপি ২টি আসন থেকে ৮৯ ও পরবর্তীতে কেন্দ্রে ক্ষমতা দখল করে। আদভানির সঙ্গী ছিলেন মুরলী মনোহর যোশি। ভূমি পূজায় তাঁরা আমন্ত্রিত ছিলেন না। বুধবার প্রধানমন্ত্রী মোদির সর্বাত্মক উপস্থিতি সত্ত্বেও আদভানি-যোশির অনুপস্থিতি অযোধ্যা ভূমিতে জেগে থাকল।
সূত্র: প্রথম আলো
তারিখ: আগষ্ট ০৫,২০২০
রেটিং করুনঃ ,