প্রসঙ্গ – মধুসূদন
নির্মাল্য ব্যানার্জ্জীর লেখায়।
শ্রী মধুসূদন দত্তকে মাইকেল বলবো না । কারণ সব শেষে নিজের এপিটাফ-এ তিনি শ্রীমধুসূদন । তাঁর সম্পর্কে অনেক তথ্যই আপনাদের জানা আছে । কাজেই অকারণে তাঁর ওপর “রচনা” লিখতে বসবো না । শুধু একটু মনে করবো, ১৮২৪ সালে জন্মানো এই বিপথগামী জিনিয়াসকে ।
তাঁর মূল্যায়ন বোধ হয় এখনও আমরা ঠিক মতো করতে পারিনি । অসাধারণ তাঁর প্রতিভা । এক সাথে তিনজন কলমচিকে বসিয়ে ডিকটেশন দিয়ে কাব্যগ্রন্থ লেখানো – এই ক্ষমতা গোটা বিশ্বে আর কখনো কারোর ছিল বলে আমার জানা নেই । তাঁর কবিতা নিঃসন্দেহে অসাধারণ । কিন্তু স্যাটায়ার ধর্মী সাহিত্যে তিনি যে দুর্লভ প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন তা বিস্ময়কর ! দুর্ভাগ্য, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাত্রা তাঁর জীবনকে শেষ করে দেয় । সম্ভবত তাঁর জমিদারী বংশের রক্ত এর জন্যে দায়ী ।
যখন তিনি খ্রীষ্ট ধর্ম গ্রহণ করায় সমাজে ভীষণ রকমের একা তখনও তাঁর বাবা তাঁকে মাসে একশো টাকা পাঠাতেন । তাঁর মাও গোপনে টাকা পাঠাতেন । সেই সময়ে অনেক সরকারী আমলার রোজগার মাসে একশো টাকা হতো না । কলেজ পড়ুয়া একটা ছেলের কাছে সেই টাকা যথেষ্ট । কিন্তু মধুসূদনের কাছে তা অতি সামান্য । কারণ তাঁর নিজের মতে, বছরে চল্লিশ হাজার টাকার কমে ভদ্রভাবে জীবনযাপন করা যায় না ।
তাঁর প্রথম বই “ক্যাপটিভ লেডি” । এই সময় তিনি ম্যাড্রাসে । এখন যার নাম চেন্নাই । এই বইটি প্রকাশ করে তার দাম ধার্য্য হয় দু’টাকা । প্রচুর প্রশংসা পেলেন কিন্তু বিক্রীর কোন নাম গন্ধ নেই । পরে “ম্যাড্রাস সারকুলেটর” নামক পত্রিকায় – “টিমোথি পেনপোয়েম” – এই ছদ্মনামে ক্যাপটিভ লেডি প্রকাশ পায় ।
মধুসূদন অনেককে বই পাঠিয়েছিলেন । তার মধ্যে বিখ্যাত বেথুন সাহেবও ছিলেন । বেথুন সাহেব কিন্তু বই পড়ে তাঁকে পরামর্শ দেন – বাংলায় লিখতে । সেই সময় তিনি বহু ভাষার চর্চা করতেন । অদ্ভুত সেই রুটিন । ৬টা থেকে ৮টা হিব্রু, ৮টা থেকে ১২টা স্কুল, ১২টা থেকে ২টো গ্রীক, ২টো থেকে পাঁচটা তেলেগু ও সংস্কৃত, পাঁচটা থেকে সাতটা ল্যাটিন আর সাতটা থেকে দশটা ইংরিজী । শুধু চর্চা হতো না বাংলা । তাই এই সময় তিনি এক বন্ধুকে লিখেছিলেন, পারলে কৃত্তিবাসী রামায়ণ আর কাশিদাসী মহাভারত পাঠাতে । কারণ – বাংলা তিনি ভুলে যাচ্ছেন ।
এর কিছুকাল পরে তিনি কলকাতা ফিরলেন । সেইসময় পাইকপাড়ার রাজারা “রত্নাবলী” নামে একটা নাটক মঞ্চস্থ করান । সে নাটক দেখতে আসবেন সাহেবরা । তাই তার ইংরিজী অনুবাদ করানোর জন্যে ডাক পেলেন মধুসূদন । অনুবাদ সকলের পছন্দ হলো । কিন্তু নাটকটা মধুসূদনের পছন্দ হলো না । তাই তিনি নিজে লিখতে শুরু করলেন বাংলা নাটক “শর্মিষ্ঠা” । নাটক লেখা হলো । এবং তা মঞ্চস্থও হলো । উচ্চ প্রশংসা পেলেন তিনি । সেই নাটকের গোড়ায় একটা বাংলা কবিতা লিখলেন তিনি । তার একটি লাইন আপনারা অনেকবার শুনেছেন । কিন্তু অনেকেই জানেন না সেটি মধুসূদনের লেখা ।
“কোথায় বাল্মীকি, ব্যাস, কোথা তব কালিদাস, / কোথা ভবভূতি মহোদয় । / অলীক কুনাট্য রঙ্গে মজে লোক রাঢ়ে, বঙ্গে / নিরখিয়া প্রাণে নাহি সয় ।”
এর পরেই তিনি লেখেন দুটি প্রহসন । তাঁর লেখা এই দুটি বই “একেই কি বলে সভ্যতা” আর “বুড় শালিকের ঘাড়ে রোঁ” – যাঁরা সাহিত্য ভালোবাসেন তাঁদের অবশ্যপাঠ্য । অনবদ্য বললে কম বলা হবে । প্রথমটায় ইংরেজদের অনুকরণকারী নব্যযুবকদের ব্যঙ্গ করেন । যদিও তিনি নিজেই সেই দলের অন্যতম ছিলেন । দ্বিতীয়টি – সমাজের প্রাচীনপন্থী লোকজনের নষ্টামিকে ব্যঙ্গ ।
এই সময়েই মহারাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের সাথে তাঁর তর্ক বাধে বাংলায় অমিত্রাক্ষর ছন্দ লেখা নিয়ে । মহারাজা বলেন সম্ভব নয় । আর মধুসূদন বলেন, আমি লিখে দেখাবো । যতীন্দ্রমোহন বললেন, যদি পারেন, আমি নিজের খরচে তাকে ছাপিয়ে দেবো ।
কিছুদিনের মধ্যেই মধুসূদন লিখে পাঠালেন – “তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য” । আগাগোড়া অমিত্রাক্ষর ছন্দে লেখা । মহারাজা তাঁর কথা রাখলেন ।
তিলোত্তমার সাথে সাথেই লিখলেন “ব্রজাঙ্গনা” । এরপর তিনি লিখলেন – লিখলেন বললে ভুল হবে । তিনি পায়চারী করতে করতে ডিকটেশান দিতে লাগলেন আর তা লেখা হতে লাগল । লেখা হলো বাংলা সাহিত্যের এক অনবদ্য সৃষ্টি – “মেঘনাদ বধ কাব্য” । আর এই বইটি প্রকাশ পেলো ১৮৬১ সালে । ঠিক যে বছর জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে জন্ম হয় একটি শিশুর – যার নাম ছিল – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর । বিপুল জনপ্রিয়তা পেল বইটি । আবার অনেকে বিদ্রুপ করতেও ছাড়েনি । অনেকে তাঁর লেখাকে ব্যঙ্গ করে বলেছে – টেবিলিলা সূত্রধর, কাপড়িলা তাঁতি ।
এই সময় মেঘনাদ বধ কাব্যকে ব্যঙ্গ করে লেখা হয়েছিল একটি বই । স্বামী বিবেকানন্দ তার সম্পর্কে লিখছেন – “এই যে মেঘনাদ বধ কাব্যকে ব্যঙ্গ করে ছুছুন্দর বধ কাব্য লিখেছে, একে কেউ মনে রাখবে ভেবেছিস ?” কিন্তু মেঘনাদ বধ কাব্য সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন – এটি কালজয়ী হবে ।
দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ এর ইংরিজী অনুবাদ করেছিলেন এই মধুসূদনই । যদিও সেটি রেভারেন্ড লং এর নাম দিয়ে প্রচার হয় ।
এত প্রতিভা তাঁর । কিন্তু কোথায় যেন এক সর্বনাশের বীজ লুকিয়ে ছিল তাঁর মধ্যে ! যে বিদ্যাসাগরের সাহায্যে তিনি ব্যারিস্টারি পাশ করে দেশে ফিরতে পারলেন, বিলেত থেকে ফেরার সময় সেই বিদ্যাসাগর তাঁর জন্যে বাড়ি ভাড়া করে রাখলেন । তিনি অক্লেশে সেটাকে প্রত্যাখ্যান করে হোটেলে গিয়ে উঠলেন । কারণ -নেটিভ পাড়ায় তিনি কখনও থাকতে পারেন ! তাঁকে শ্রী মধুসূদন লিখেছিলেন বলে বিদ্যাসাগরের চিঠি তিনি না পড়ে ফেরত পাঠিয়েছেন ।
ব্যারিস্টারি জীবনের প্রথম বছরে তাঁর মাসিক আয় ছিল দেড় থেকে দু’ হাজার টাকা । সেকালের হিসেবে অনেক টাকা । কিন্তু অসম্ভব উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনের ফলে তা কর্পূরের মতো উবে যেত । স্পেনসার্স হোটেলে একা তিনখানা ঘর নিয়ে তিনি থাকেন । প্রতি মাসে ফ্রান্সে টাকা পাঠাতে হয় । আর বন্ধু এবং বন্ধুর ভান করা অজস্র লোক তাঁর পয়সায় পানাহার করে । কাজেই টাকার অভাব আর ধার করা চলতেই থাকে । আর টাকা ফুরোলেই মনে পড়ে “ভিদ্” অর্থাৎ বিদ্যাসাগরকে ।
এবং বিদ্যাসাগর এতো কিছুর পরেও তাঁকে অর্থসাহায্য করেছেন । কারণ ? গল্প শুনেছিলাম, এক মাতাল নাকি খেয়াল করে মাইকেল এসে বিদ্যাসাগরের কাছে টাকা নেয়, আর তারপর সোজা চলে যায় আবগারীর দোকানে । সেও এসে বিদ্যসাগরকে ধরে । তুমি মাইকেলকে মদ খাওয়ার টাকা দাও, আমাকেও দিতে হবে । বিদ্যাসাগর তাই শুনে বলেন – তুমি মেঘনাদ বধের মতো একটা কাব্য লিখে আনো, তোমাকেও দেবো ।
শেষ অবধি ১৮৭৩ সালে চরম আর্থিক কষ্টের মধ্যে আলিপুর দাতব্য হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয় । এই প্রতিভাধর কবি-সাহিত্যিকের মৃত্যুদিন – ২৯শে জুন । তাঁর প্রতি আমার প্রণাম রইল । মৃত্যুর আগে তিনি বারবার আবৃত্তি করতেন – ম্যাকবেথ এর কয়েকটি লাইন । মনে পড়ছে সেই লাইনগুলোই –
“Life’s but a walking shadow, a poor player,
That struts and frets his hour upon the stage,
And then is heard no more. It is a tale
Told by an idiot, full of sound and fury,
Signifying nothing.”
সূত্র: সংগৃহিত।
তারিখ: জুন ২৯, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,