Welcome to rabbani basra

আমার লেখালাখির খাতা

শুরু হোক পথচলা !

Member Login

Lost your password?

Registration is closed

Sorry, you are not allowed to register by yourself on this site!

You must either be invited by one of our team member or request an invitation by email at info {at} yoursite {dot} com.

Note: If you are the admin and want to display the register form here, log in to your dashboard, and go to Settings > General and click "Anyone can register".

অনেক শ্রদ্ধায় মাষ্টারদা সূর্য সেন

Share on Facebook

স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং বিপ্লবী যোদ্ধা হুতাত্মা মাষ্টারদা সূর্য সেনের জন্মঃ- ২২ মার্চ, ১৮৯৪ – মৃত্যুঃ- ১২ জানুয়ারি, ১৯৩৪

১৯১৬ সালে বহররমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজের ছাত্র থাকাকালীন সময়ে সূর্য সেন সরাসরি রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত হন। বিপ্লবীদের গোপন ঘাঁটি এই কলেজ়ে তিনি অধ্যাপক সতীশচন্দ্র চক্রবর্তীর সান্নিধ্যে আসেন। তিনি যুগান্তর দলের সাথে যুক্ত ছিলেন। সূর্য সেনকে তিনি বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষা দেন। সূর্য সেন ১৯১৮ সালে শিক্ষাজীবন শেষ করে চট্টগ্রামে এসে গোপনে বিপ্লবী দলে যোগ দেন। ৪৯নং বেঙ্গল রেজিমেন্টের নগেন্দ্রনাথ সেন ১৯১৮ সালে চট্টগ্রামে এসে সূর্য সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী ও চারুবিকাশ দত্তের সাথে দেখা করেন। সূর্য সেন এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী অম্বিকা চক্রবর্তী একই থানার পাশাপাশি গ্রামের ছাত্র হিসেবে ছোটবেলা থেকেই পরস্পরের কাছে পরিচিত ছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৯১৮) শেষের দিকে অনুরূপ সেন, চারুবিকাশ দত্ত, অম্বিকা চক্রবর্তী, নগেন্দ্রনাথ সেন প্রমুখদের সঙ্গে নিয়ে চট্টগ্রামে গোপন বিপ্লবী দল গঠন করা হয়। এখানে উল্লেখ্য, শুরুতে চট্টগ্রামের বিপ্লবী দল একটিই ছিল। তারা বাংলার প্রধান দু’টি বিপ্লবী দল “যুগান্তর” এবং “অনুশীলন”- কোনটির সাথে একেবারে না মিশে গিয়ে স্বতন্ত্রভাবে কাজ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল।

বিপ্লবী নেতা সূর্য সেন এবং অম্বিকা চক্রবর্তী তখন চট্টগ্রাম শহরের দেওয়ানবাজার দেওয়ানজী পুকুরপারে ‘সাম্য আশ্রম’ প্রতিষ্ঠা করে ওখানে থাকেন। সেখানে গোপনে বিপ্লবীরা জমায়েত হয়। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম বিপ্লবী দলের অন্যতম নেতা চারুবিকাশ দত্ত তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে “অনুশীলন” দলের সাথে যুক্ত হয়ে যান। এভাবে চট্টগ্রামেও বাংলার অন্যান্য জেলার মত দু’টি বিপ্লবী দল গড়ে ওঠে। দুই দলে বিভক্ত হওয়ার পর চট্টগ্রামে যে বিপ্লবী দলটি নিজস্ব স্বতন্ত্রতা বজায় রেখে কংগ্রেসের প্রকাশ্য আন্দোলনে কোলকাতার “যূগান্তর” দলের সঙ্গে সহযোগিতা করত, সে দলের সাংগঠনিক কমিটি ছিল নিম্নরূপ- সভাপতি- সূর্য সেন; সহসভাপতি- অম্বিকা চক্রবর্তী; শহর সংগঠনের দায়িত্বে- গণেশ ঘোষ ও অনন্ত সিংহ; গ্রামের সংগঠনের দায়িত্বে- নির্মল সেন। এছাড়া লোকনাথ বলকে ছাত্র আন্দোলন ও ব্যায়ামাগার গঠন প্রভৃতি কাজের দায়িত্ব দেয়া হয়। অনুরূপ সেন বিপ্লবীদলের সংবিধান লিখলেন এবং তাঁকে ও নগেন্দ্রনাথ সেনকে কলকাতার অন্য দলগুলোর সাথে যোগাযোগ এবং অস্ত্র সংগ্রহের দায়িত্ব দেয়া হয়।

নাগরখানা পাহাড় খন্ডযুদ্ধ
১৯২০ সালে গান্ধীজী- কর্তৃক অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে অনেক বিপ্লবী এই আন্দোলনে যোগ দেন। গান্ধীজীর অনুরোধে বিপ্লবীরা তাদের কর্মসূচি এক বছরের জন্য বন্ধ রাখেন। সূর্য সেন অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিলেন। চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল স্কুলের দশম শ্রেনীর ছাত্র ও বিপ্লবী অনন্ত সিংহ ছাত্র ধর্মঘট পরিচালনা করার জন্য স্কুল থেকে বহিস্কৃত হন। মহাত্মা গান্ধী ১৯২২ সালে অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করলে বিপ্লবী দলগুলো আবার সক্রিয় হয়ে উঠে। তখন চট্টগ্রাম কোর্টের ট্রেজারী থেকে পাহাড়তলীতে অবস্থিত আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে কারখানার শ্রমিক ও কর্মচারীদের বেতন নিয়ে যাওয়া হতো। ১৯২৩-এর ১৩ ডিসেম্বর টাইগার পাস এর মোড়ে সূর্য সেনের গুপ্ত সমিতির সদস্যরা প্রকাশ্য দিবালোকে বেতন বাবদ নিয়ে যাওয়া ১৭,০০০ টাকার বস্তা ছিনতাই করে। ছিনতাইয়ের প্রায় দুই সপ্তাহ পর গোপন বৈঠক চলাকালীন অবস্থায় পুলিশ খবর পেয়ে বিপ্লবীদের আস্তানায় হানা দিলে পুলিশের সাথে বিপ্লবীদের খন্ড যুদ্ধ হয় যা “নাগরখানা পাহাড় খন্ডযুদ্ধ” নামে পরিচিত।

যুদ্ধের পর গ্রেফতার হন সূর্য সেন এবং অম্বিকা চক্রবর্তী। রেলওয়ে ডাকাতি মামলা শুরু হয় সূর্য সেন এবং অম্বিকা চক্রবর্তীকে নিয়ে। অনন্ত সিং আর গণেশ ঘোষের নামে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করা হয়। কলকাতা হাইকোর্টের ব্যারিস্টার দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত এই মামলায় আসামি পক্ষের আইনজীবি ছিলেন। সূর্য সেন এবং অম্বিকা চক্রবর্তী এ মামলা থেকে ছাড়া পেয়ে যান। গ্রেফতার করার পর বিপ্লবীদের উপর নির্যাতনের কারনে কলকাতা পুলিশ কমিশনার টেগার্টকে হত্যা করার পরিকল্পনা করে বিপ্লবীরা। এই পরিকল্পনার কথা পুলিশ আগে থেকেই জানতে পারে। এ কারনে ২৫ অক্টোবর ১৯২৪ সালে গ্রেফতার হন গণেশ ঘোষ, নির্মল সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী, অনন্ত সিং সহ আরো কয়েকজন। পুলিশকে বার বার ফাঁকি দিয়ে শেষ পর্যন্ত ১৯২৬ সালের ৮ অক্টোবর সূর্য সেন কলকাতার ওয়েলিংটন স্ট্রীটে গ্রেফতার হন। বন্দী হবার পর তাঁকে মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলে রাখা হয়। পরে বোম্বের রত্নগিরি জেলে পাঠানো হয়, সেখান থেকে বেলগাঁও জেলে। ১৯২৭ সালে নির্মল সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী, অনন্ত সিং মুক্তি পান। আর ১৯২৮ সালের শেষভাগে সূর্য সেন ও গণেশ ঘোষ জেল থেকে ছাড়া পান।

বিপ্লবী সংগঠনে মেয়েদের অংশগ্রহণ
বিপ্লবী সংগঠনে মেয়েদের সদস্য করার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা ছিল। বিপ্লবীদের প্রতি মা, নিজের বোন এবং অন্যান্য নিকট আত্নীয় ছাড়া অন্য মেয়েদের সাথে মেলামেশা না করার নির্দেশ ছিলো মাষ্টার’দা সূর্য সেনের। পরে তিনি এই নির্দেশ শিথিল করেন। এতে পরবর্তীতে কল্পনা দত্ত ও প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার বিপ্লবী সংগঠনে যোগ দেন।

ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি
১৯২৮ সালে কলকাতার পার্ক সার্কাসে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির বার্ষিক অধিবেশন হয়। ঐ অধিবেশনে চট্টগ্রাম থেকে যে প্রতিনিধিরা ছিলেন তাঁরা হলেন সূর্য সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী, অনন্ত সিং, নির্মল সেন, লোকনাথ বল, তারকেশ্বর দস্তিদার প্রমুখ। সেখানে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোসের সাথে সূর্য সেনের সাথে বৈঠক হয়। ১৯২৯ সালে মহিমচন্দ্র দাস এবং বিপ্লবী সূর্য সেন যথাক্রমে চট্টগ্রাম জেলা কংগ্রেসের সভাপতি এবং সম্পাদক নির্বাচিত হন। ঐ বছর বিপ্লবী নেতাদের উপর পুলিশের পাহারা আরো জোরদার করার জন্য কলকাতার কেন্দ্রীয় অফিস থেকে নির্দেশ আসে। ১১ জন গোয়েন্দা এবং চব্বিশজন পুলিশ নিয়োগ করা হলো ছয়জন বিপ্লবী নেতার জন্য। ১৯৩০ সালের শুরু থেকেই আসকার খাঁর দিঘির পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত কংগ্রেস অফিসে সূর্য সেন এবং অম্বিকা চক্রবর্তী ভবিষ্যৎ এর সশস্ত্র বিপ্লবের রুপরেখা নিয়ে বিভিন্ন নেতা কর্মীদের সাথে আলোচনা করতেন। এসব আলোচনার পর ঠিক করা হয় শুধু শহর না, বরং বিভিন্ন গ্রাম এবং কক্সবাজার থেকেও বিপ্লবীদের নেয়া হবে। আইরিশ রিপাবলিকান আর্মির বিপ্লবের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজেদের দলের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় “ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি, চিটাগাং ব্রাঞ্চ”। বাংলায় “ভারতীয় প্রজাতান্ত্রিক বাহিনী, চট্টগ্রাম শাখা”।

পরিকল্পনা অনুসারে কাজের জন্য কয়েকটা দল গঠন করা হয়। সূর্য সেনের দলের সদস্য সংখ্যা ছিল ৩৫ জন, অম্বিকা চক্রবর্তীর ১৫ জন, অনন্ত সিং এবং গণেশ ঘোষের ২২ জন, নির্মল সেনের ৬ জন। এই দলগুলোর মধ্যে আবার উপদল ছিল। ইতোমধ্যেই চলছিলো অস্ত্র সংগ্রহ এবং বোমা তৈরির কাজ।

চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন ও জালালাবাদ যুদ্ধ
১৮ এপ্রিল ১৯৩০, শুক্রবার রাত ৮টা বিদ্রোহের দিন হিসাবে ঠিক হয়। পরে তা দশটা করা হয়। চারটা বাড়ি হতে চারটা দল আক্রমণের জন্য বের হয়। সে রাতেই ধুম রেলস্টেশনে একটা মালবহনকারী ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে উল্টে যায়। একদল বিপ্লবী আগে থেকেই রেল লাইনের ফিসপ্লেট খুলে নেয়। এর ফলে চট্টগ্রাম সমগ্র বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অন্য একটি দল চট্টগ্রামের নন্দনকাননে টেলিফোন এবং টেলিগ্রাফ অফিস আক্রমণ করে। হাতুড়ি দিয়ে তারা সব যন্ত্রপাতি ভেঙ্গে দেয় এবং পেট্রোল ঢেলে সেখানে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয়। আরেকটি দল পাহাড়তলীতে অবস্থিত চট্টগ্রাম রেলওয়ে অস্ত্রাগার দখল করে নেয়। উন্নতমানের রিভলবার ও রাইফেল গাড়ীতে নিয়ে অস্ত্রাগারটি পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগানো হয়। তবে সেখানে কোনো গুলি পাওয়া যায়নি। সর্বশেষ পরিকল্পনা অনুযায়ী বিপ্লবীরা দামপাড়ায় পুলিশ রিজার্ভ ব্যারাক দখল করে নেয়। এই আক্রমনে অংশ নেয়া বিপ্পবীরা দামপাড়া পুলিশ লাইনে সমবেত হয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। মিলিটারি কায়দায় কুচকাওয়াজ করে সূর্য সেনকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সূর্য সেন অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার গঠনের ঘোষনা করেন।
চট্টগ্রাম সম্পূর্ণরুপে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত ছিল চারদিন। কিন্তু এরমধ্যে বিপ্লবীদের খাদ্যসংকট দেখা দিল এবং সূর্য সেন সহ অন্যদের কচি আম, তেঁতুল পাতা, কাঁচা তরমুজ এবং তরমুজের খোসা খেয়ে কাটাতে হয়। সূর্য সেন সহ ছয়জন শীর্ষস্থানীয় বিপ্লবীকে ধরার জন্য ইংরেজ সরকার ৫০০০ টাকা পুরস্কার ঘোষনা করে। ১৯৩০ সালের ২২ এপ্রিল বিপ্লবীরা যখন জালালাবাদ পাহাড়ে (চট্টগ্রাম সেনানিবাসের পাহাড়) অবস্থান করছিল সে সময় সশস্ত্র ইংরেজ সৈন্যরা তাঁদের আক্রমণ করে। দুই ঘন্টার প্রচন্ড যুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনীর ৭০ থেকে ১০০ জন এবং বিপ্লবী বাহিনীর ১২ জন নিহত হয়।

সূর্য সেনকে ধরার ব্যর্থ অভিযান
জালালাবাদ যুদ্ধের পর বিপ্লবী নেতাদের ধরার জন্য রেলস্টেশন, স্টীমারঘাট হতে শুরু করে সব স্থানে অভিযান চলছিলো। বিপ্লবীরা তখন বিভিন্ন জায়গায় বিচ্ছিন্নভাবে আত্মগোপন করে ছিলো। সূর্য সেন ১৬ জন বিপ্লবীকে নিয়ে ২৪ এপ্রিল রাতে নিজ বাড়িতে আসেন। এর মধ্যে অনন্ত সিং পুলিশের কাছে স্বেচ্ছায় ধরা দেন এবং কয়েকজনকে পুলিশ আটক করে এবং এদের বিরুদ্ধে অস্ত্রাগার লুন্ঠন মামলা শুরু হয়। এ মামলা শুরু হওয়ার পর অসুস্থ অম্বিকা চক্রবর্তী পটিয়া থানার চক্রশালা গ্রামে গ্রেপ্তার হন। অম্বিকা চক্রবর্তী এবং সেসময় গ্রেপ্তার হওয়া অন্য বিপ্লবীদের নিয়ে দ্বিতীয় অস্ত্রাগার লুন্ঠন মামলা শুরু হয়। প্রায় ১৯ মাস বিচারের পর ১৯৩২ সালের ১লা মার্চ অস্ত্রাগার লুন্ঠন মামলার রায়ে অনন্ত সিং, লোকনাথ বল এবং গনেশ ঘোষসহ ১২ জনকে দ্বীপান্তর বাসের আদেশ দেয়া হয়। পরবর্তীতে অপর মামলায় অম্বিকা চক্রবর্তীর প্রাণদন্ডের আদেশ হয় পরে হাইকোর্টে আপিলের রায়ে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়া হয়। এ রায়ের পর সূর্য সেনকে ধরার জন্য পটিয়া এবং গোমদন্ডীতে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়। সরকার ৫০০০ টাকার পরিবর্তে ১০,০০০ পুরস্কার ঘোষনা করে। ১৯৩২ সালের ১৩ জুন রাত ৯টায় পটিয়ার ধলঘাট গ্রামে সাবিত্রী চক্রবর্তীর বাড়িতে তাঁকে ধরার চেষ্টা ব্যর্থ হয়। ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন ক্যামেরনকে গুলি করে সূর্য সেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এবং কল্পনা দত্ত পালিয়ে যেতে সক্ষম হন কিন্তু নির্মল সেন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।

ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমন
১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিলের (চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের দিন) অন্যতম একটি পরিকল্পনা ছিল পাহাড়তলী ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণ কিন্তু গুড ফ্রাইডে থাকায় সেদিন ঐ ক্লাবে কেউ ছিল না। মাস্টার’দা সূর্য সেন স্থির করেন ২৩ সেপ্টেম্বর (১৯৩২ সাল) ইউরোপীয় ক্লাবে প্রীতিলতার নেতৃত্বে হামলা করা হবে। এ প্রসঙ্গে মাস্টার’দা লিখেছেন
“বাংলায় বীর যুবকের আজ অভাব নাই। বালেশ্বর থেকে জালালাবাদ, কালারপোল পর্যন্ত এদের দৃপ্ত অভিযানে দেশের মাটি বারে বারে বীর যুবকের রক্তে সিক্ত হয়েছে। কিন্তু বাংলার ঘরে ঘরে মায়ের জাতিও যে শক্তির খেলায় মেতেছে, ইতিহাসে সে অধ্যায় আজও অলিখিত রয়ে গেছে। মেয়েদের আত্মদানে সে অধ্যায় রচিত হোক এই-ই আমি চাই। ইংরেজ জানুক, বিশ্বজগৎ জানুক, এদেশের মেয়েরাও মুক্তিযুদ্ধে পেছনে নেই”।
২৩ সেপ্টেম্বর রাতে প্রীতিলতা সূর্য সেন-এর নির্দেশে ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণ করেন। হামলায় ৫৩ জন ইংরেজ হতাহত হয়েছিল। গুলিতে আহত প্রীতিলতা দৈহিকভাবে অত্যাচারিত হওয়ার চাইতে থেকে স্বেচ্ছামৃত্যুকে বেছে নিলেন। তিনি পটাসিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন।

গ্রেপ্তার
ইংরেজ প্রশাসন সূর্য সেনকে জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় ধরার জন্য সর্বাত্নক চেষ্টা অব্যাহত রাখে। সূর্য সেন গৈরলা গ্রামে ক্ষীরোদপ্রভা বিশ্বাসের বাড়িতে আত্মগোপন করে ছিলেন। ১৯৩৩ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারী রাতে সেখানে এক বৈঠকে ছিলেন কল্পনা দত্ত, শান্তি চক্রবর্তী, মণি দত্ত, ব্রজেন সেন আর সুশীল দাসগুপ্ত। ব্রজেন সেনের সহোদর নেত্র সেন সূর্য সেনের উপস্থিতির খবর পুলিশকে জানিয়ে দেয়। রাত প্রায় ১০টার দিকে পুলিশ আর সেনাবাহিনী ক্ষীরোদপ্রভা বিশ্বাসের বাড়িটি ঘিরে ফেলে। রাতের অন্ধকারে গুলি বিনিময় করে কল্পনা দত্ত, শান্তি চক্রবর্তী, মণি দত্ত আর সুশীল দাসগুপ্ত পালিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু রাত ২টার দিকে অস্ত্রসহ সূর্য সেন এবং ব্রজেন সেন ধরা পড়েন। তারপর ঐ বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে পুলিশ সূর্য সেনের নিজের হাতে লেখা অর্ধসমাপ্ত আত্মজীবনীর খাতা উদ্ধার করে। সেই খাতার উপর লেখা ছিল “বিজয়া”। বিচারের সময় “বিজয়াতে” লেখা তাঁর কথাগুলো বিপ্লব এবং প্রশাশনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের প্রমান হিসাবে অনেকবার ব্যবহার করা হয়। ১৭ই ফেব্রুয়ারী রাতে সূর্য সেন এবং ব্রজেন সেনকে প্রথমে জেলা গোয়েন্দা সদর দপ্তরে, পরে কোর্ট হয়ে চট্টগ্রাম জেলে নেয়া হয়। সূর্য সেন গ্রেফতার হবার পর তারকেশ্বর দস্তিদার দলের নেতৃত্ব গ্রহন করেন। কিন্তু ১৯৩০ সালের ১৮ই মে আনোয়ারা থানার গহিরা গ্রামে পুলিশ আর মিলিটারীর সাথে সংঘর্ষের পর তারকেশ্বর দস্তিদার এবং কল্পনা দত্ত গ্রেপ্তার হন। ১৯৩৩ সালের মার্চ মাসে বিপ্লবীরা জেল থেকে সূর্য সেনকে মুক্ত করার জ়ন্য কয়েকবার চেষ্টা চালায়। প্রতিবারই তাদের গোপন পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যায়।

শেষ দিনগুলো এবং ফাঁসির বিবরণ
কনডেম্ড সেলে সূর্য সেনকে কড়া পাহারায় নির্জন কুঠুরীতে রাখা হত। একজন কয়েদি মেথর সূর্য সেনের লেখা চিঠি ময়লার টুকরিতে নিয়ে জেলের বিভিন্ন ওয়ার্ডে বন্দী বিপ্লবীদের দিয়ে আসতো। মৃত্যুর আগে জেলে আটক বিপ্লবী কালীকিঙ্কর দে’র কাছে সূর্য সেন পেন্সিলে লেখা একটি বার্তা পাঠান। সে বার্তায় তিনি লেখেন “আমার শেষ বাণী-আদর্শ ও একতা”। তিনি স্মরণ করেন তাঁর স্বপ্নের কথা–স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন যার জন্য জীবনভর উৎসাহ ভরে ও অক্লান্তভাবে পাগলের মত তিনি ছুটেছেন। তাঁর ভাষায় “ভারতের স্বাধীনতার বেদীমূলে যে সব দেশপ্রেমিক জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাদের নাম রক্তাক্ষরে অন্তরের অন্তরতম প্রদেশে লিখে রেখো”। তিনি সংগঠনে বিভেদ না আসার জন্য একান্তভাবে আবেদন করেন । শেষ দিনগুলোতে জেলে থাকার সময় তাঁর একদিন গান শোনার খুব ইচ্ছা হল। সেই সময় জেলের অন্য এক সেলে ছিলেন বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী। রাত ১১টা/১২টার দিকে কল্পনা দত্ত তাঁকে চিৎকার করে বলেন “এই বিনোদ, এই বিনোদ, দরজার কাছে আয়। মাষ্টারদা গান শুনতে চেয়েছেন”। বিনোদ বিহারী গান জানতেন না। তবুও সূর্য সেনের জন্য রবিঠাকুরের “যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে” গানটা গেয়ে শোনালেন।
১৯৩৪ সালের ১২ই জানুয়ারী মধ্যরাতে সূর্য সেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারের ফাঁসী কার্যকর হবার কথা উল্লেখ করা হয়। তাঁদের উপর ব্রিটিশ সেনারা নির্মম ভাবে অত্যাচার করে। হাতুরী দিয়ে তাঁদের দাঁত এবং হাড় ভেঙ্গে দেয়। সূর্য সেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারের লাশ আত্মীয়দের হাতে হস্তান্তর করা হয়নি এবং সংস্কার অনুযায়ী পোড়ানো হয়নি। ফাঁসীর পর লাশদুটো জেলখানা থেকে ট্রাকে করে ৪ নম্বর স্টীমার ঘাটে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর মৃতদেহ দুটোকে ব্রিটিশ ক্রুজার “The Renown” এ তুলে নিয়ে বুকে লোহার টুকরো বেঁধে মহাসাগরের কোনো একটা জায়গায় ফেলে দেয়া হয়।
……………
তথ্য সংগৃহীত – প্রতাপ সাহা।

এক সেনাপতি, এক সৈন্য ও এক বিশ্বাসঘাতকের গল্প..

সংযোগ বশত এরা তিনজনই #সেন। প্রথমজনকে নিয়ে বাঙালি আজও গর্ব করে, তৃতীয় জনকে ঘৃণা। আর দ্বিতীয়জন ? তাঁকে তো আমরা চিনলামই না !

২রা ফেব্রুয়ারী ১৯৩৩ ….
পলাতক সূর্য সেনকে গৈরালা গ্রামে নিয়ে এসেছেন বিপ্লবী ব্রজেন সেন । মাষ্টারদার সাথে রয়েছেন তার একান্ত অনুগত শান্তি, কল্পনা দত্ত, সুশীল ও মণি দত্ত । তাঁরা ছিলেন গ্রামের বিশ্বাস বাড়িতে, পরম যত্নে আগলে রেখেছিলেন সে বাড়ির বড়বধূ ক্ষিরোদপ্রভা ।

বেশ ছিলেন কিন্ত বিপদ এলো অন্য দিক দিয়ে । প্রতিবেশী নেত্র সেনের সন্দেহ হলো কারা আছে বিশ্বাস বাড়িতে ? কিসের এত ফিসফাস গুঞ্জন । খবর লাগাতে বললেন নিজের গিন্নিকে ।
গ্রাম্য বধূটি সরল মনে এসে বললো ও বাড়িতে সূর্য সেন লুকিয়ে আছে গো ! অমন লোককে খাওয়ালেও যে পূণ্যি লাভ !
শুনে লাফ দিয়ে উঠলো নেত্র । খবর দিলেই যে কড়কড়ে দশ হাজার টাকা ! বউকে আশ্বস্ত করে
ব্যাগ হাতে তখনই বেরিয়ে পড়লো, সোজা উঠলো গিয়ে থানায় ।

সেদিন রাতে ঘুম ভাঙতে চমকে উঠলো ব্রজেন , জানলা দিয়ে লণ্ঠন দেখিয়ে কি করছে দাদা #নেত্র_সেন ? এক মিনিটও লাগলো না বুঝতে, ছুট লাগালেন বিশ্বাস বাড়ির দিকে । দেরী হয়ে গেছে ততক্ষনে, ক্যাপ্টেন ওয়ামসলের নেতৃত্বে গোটা বাড়ি ঘিরে ফেলেছে গোর্খা সেনার দল।রকেট বোমার আলোতে সবকিছু দিনের মতো স্পষ্ট ।

পরদিন সমস্ত সংবাদপত্রের হেডলাইন….. গৈরালা নামক গ্রামে সূর্য সেন গ্রেফতার । এনাকে ধরবার জন্য সরকার দশহাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করিয়াছিলেন ।( অমৃতবাজার পত্রিকা ১৭.২.১৯৩৩)

তিনদিন পর………
সন্ধে বেলায় জলখাবার খেতে বসেছে নেত্র সেন,পাশে স্ত্রী । দরজায় শব্দ হতে উঠে গিয়ে খুলে দিলেন। পাড়ারই চেনা ছেলে দেখা করতে এসেছে স্বামীর সঙ্গে । সবে উনি ভাবছেন সেখান থেকে সরে যাবেন কিনা, আচমকা পাড়ার সেই ছেলের হাতের ভোজালির কোপে স্বামীর মুণ্ডু ছিটকে পড়লো!

থরথর কাঁপছেন গ্রাম্য বধূ । ঘাতক যাওয়ার আগে বলে গেলেন, মাস্টার দার সঙ্গে বেইমানি করার উপযুক্ত শাস্তি ।

বৃটিশ পুলিশ কতবার কতভাবে জেরা করেছে সাধারণ আটপৌরে ঐ বধূটিকে। একবার তিনি বলুন স্বামীর ঘাতকের নাম। মুখ খোলেননি নেত্র সেনের বিধবা |
শুধু বলেছিলেন চোখের সামনে তিনি স্বামীকে লুটিয়ে পড়তে দেখে মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত । স্বামী হারানোর যন্ত্রণায় এখন কষ্ট পাচ্ছেন, আর কিছুই বলার নেই ।কিন্তু যে মানসিক যন্ত্রণায় তিনি সবথেকে বেশি কষ্ট পাচ্ছেন তা হল এই জেনে যে তাঁর স্বামী নেত্র সেন একজন বিশ্বাসঘাতক, যিনি পুলিশের পুরস্কারের লোভে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন মাস্টার দার মতো ব্যক্তির সঙ্গে । তাই তাঁকে হত্যা করে ঠিকই করেছেন মাস্টার দার সহযোগী ঐ তরুণ। মেরে ফেললেও তিনি ওই বিপ্লবীর নাম ফাঁস করবেন না ।

হয়রানির বেশি আর কিছু নেত্র সেনের স্ত্রীকে করেনি ব্রিটিশ পুলিশ | ততদিনে তাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়ে গেছে | কারাগারে নির্মম অত্যাচার করা হচ্ছে মাস্টার দার উপরে |

অনেকদিন পর জানা গেছিল হত্যাকারী আর কেউ নয়, ….. …..সেন বংশের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার দায়িত্ব স্বেচ্ছায় নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল ঐ বাড়িরই ছোট ছেলে #কিরণ_সেন । মাষ্টারদা মরার আগে জেনে গেছিলেন দেশদ্রোহীকে চরম দন্ড দিতে তাঁর মন্ত্রশিষ্যরা এতটুকু দয়া দেখায়নি ।
মুক্তির মন্দিরের সোপান তলে এরকম কত কিরণ নিঃশব্দে দিয়েছে বলিদান ……আমরা মনে রাখিনি।

বাঙালির সর্বকালের শ্রেষ্ঠ এই সেনাপতির জন্মদিনে আজ স্মরণ করি স্বাধীনতার সেই অনামী সেনানীকে। আর প্রণাম জানাই সেই গ্রাম্য বধুকে, শত প্রলোভনেও যিনি উচ্চারণ করেননি তার বিশ্বাসঘাতক স্বামীর হত্যাকারীর নাম

“তোমাকে ভুলে গেলে নিজেকে ভুলে যাওয়া।
তোমার বিপ্লব আজও উদিয়মান সূর্যের আলোর মতো।
যতোদিন এই পৃথিবীতে সূর্য উঠবে, ততোদিন তুমি থাকবে।”

লেখক: স্বপন সেন

সূত্র: সংগৃহিত।
তারিখ: মার্চ ২২, ২০২১

রেটিং করুনঃ ,

Comments are closed

বিভাগসমূহ

Featured Posts

বিভাগ সমুহ